Monthly Archives: অগাষ্ট 2011

জাহাজ শিল্প, উন্নয়নের নবদিগন্ত

১। নদীমাতৃক আমাদের এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ। হাজার নদীর অববাহিকা মিলে তৈরী  হয়েছে একটি ব’দ্বীপ  যার নাম বাংলাদেশ। নদী নালা দিয়ে এ দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যে কোন প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে কোন বাধা নেই। ভৌগলিক কারণেই এমনটি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ। প্রাচীন কালে হয়তোবা কলা গাছের ভেলা কিংবা তাল গাছ চিরে দুই ফালি করে নৌকার মত করে কিংবা অগত্যা মাটির তৈরি চারিতে বসে নদী নালা খালবিল পাড়ি দিত আমাদের পূর্ব পুরুষেরা।

পরবর্তীতে বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা যখন একটু বেশী হল তখন কাঠের তক্তা বানিয়ে জুড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে একদিন রীতিমত নৌকা হয়ে গেল। এখন আর শুধু একা নিজে নয় পাড়া পড়শি  এবং মালামাল সহ ইচ্ছেমত বৈঠা বা লগি দিয়ে বেয়ে যেখানে খুশি সেখানে যেতে বাধা নেই।

২। কিন্তু সম্ভাবনার এই দেশে এই ব্যবস্থা আর কদিন? এক সময় দেশ নানা জাতির অধীনে পরাধীন থেকে স্বাধীনতা পেল। নিজেদের জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা কেন্দ্র প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হল নানা বিষয়ে অধ্যায়ন এবং গবেষণা। তেমনি জাহাজ নির্মাণের জন্য যুক্ত হল “ন্যাভাল আর্কিটেক্ট এন্ড ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ারিং” নামের উপযুক্ত একটি ঝাঁঝালো বিষয়। নৌ চলাচল ও নাবিক বিদ্যা শিক্ষার জন্য তৈরি হল ম্যারিন একাডেমী, ডেক পারসনাল ট্রেনিং সেন্টার এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ম্যরিন টেকনোলজি।
শোনা যাছে দেশে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সুইডেনের বিখ্যাত মালমো ম্যারিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরূপ একটি ম্যারিন বিশ্ববিদ্যালয়। এক্ষেত্রে আমরা  আশা করব এখানে নৌ বিদ্যার পাশাপাশি নৌ নির্মান সংক্রান্ত একটি বিষয় থাকবে যেখানে ছাত্ররা পাবে উচ্চতর ডিগ্রি। যার তুলনা হবে বিশ্বমানের সাথে।

৩। এক সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি এমন একটি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করে এগিয়ে এসেছেন তরুন ন্যাভাল আর্কিটেক্ট ও প্রকৌশলী মোঃ শামসুল আলম। চোখে উদ্দীপনাময় স্বপ্ন, দেশ গড়ার আগ্রহ এবং উন্নয়নের একাগ্রতা নিয়ে ম্যারিন হাউজ নামে একটি ডিজাইন এবং কনসাল্টিং হাউজ খুলেছেন  তার কয়েকজন সঙ্গী সাথী নিয়ে। নিজের শক্ত হাতে তুলে ধরেছেন এর হাল। আমি দেখছি তিনি দিনের মধ্যে প্রায় ১৮ ঘন্টা নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সপ্তাহের প্রতিটি দিন। প্রায় ৩০/৪০ জন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে সর্বক্ষণ তাদের মেধা এবং প্রতিভা প্রয়োগ করে চালিয়ে যাচ্ছেন  ডিজাইন তৈরি এবং গবেষণার কাজ। কিসে উন্নতি হবে, স্বল্প ব্যয়ে নির্মাণ করা সম্ভব হবে আভ্যন্তরীণ নৌপথে পরিবহনের জন্য ইঞ্জিন চালিত জাহাজ। অনবরত সংগ্রহ করে চলেছেন বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। তাদের ডিজাইন এবং তত্ত্বাবধান অনুযায়ী দেশের বেশ অনেকগুলি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান নিজেদের আভ্যন্তরীণ পরিবহন প্রয়োজন মেটাবার লক্ষে নির্মাণ করছে আভ্যন্তরীণ জাহাজ। যেমন-
আবুল খায়ের গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ সহ অনেকেই। আর এগুলির সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে ম্যারিন হাউজের তরুণ ও দক্ষ প্রকৌশলীর আর একটি দল। কোথাও কোন ভুল ভ্রান্তি হচ্ছে কি না কিংবা ডিজাইনের সাথে কোন তারতম্য হচ্ছে কিনা এবং সর্বোপরি গুনগত মান নিশ্চিত করার কাজে এরা সর্বক্ষণ নিয়োজিত রয়েছে। এদের কাজকর্মের ধারা দেখে আমার মনে হচ্ছে কোন এক সময় উদীয়মান এই শিল্প বিকাশে বাংলাদেশের মূল পথিকৃত হয়ে থাকবে এই ম্যারিন হাউজ এবং এর কলা কুশলিবৃন্দ।

উপরে এদের নির্মানাধীন কয়েকটি জাহাজের ছবিঃ এখানে নির্মিত হচ্ছে ২,৫০০ টন ধারন ক্ষমতার ৮ টি কোস্টাল জাহাজ যা বিশ্বের যে কোন সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা দিয়েও চলাচলে সক্ষম।

৪। এই দেশের জন গোষ্ঠীর চাহিদার যাবতীয় মালামাল বা পণ্যের সিংহ ভাগ পরিবহন করা হয় সড়ক বা রেল পথে যা অত্যন্ত ব্যয় বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।  এতে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে সড়ক পথে যানজট। যা এখন এক বিশাল জাতীয় সমস্যা। যার অত্যাচারে আজকাল দেশের মানুষের জীবন হয়ে পরেছে অতিষ্ঠ। মানুষের চলাচল বা দৈনন্দিন কাজ হচ্ছে বিঘ্নিত। প্রতি দিন এই জ্যামের কারণে দেশকে গুনতে হচ্ছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার লোকসান, ফলে মাথাপিছু পরছে প্রায় ৫২/০০ টাকা। অথচ নৌপথে পরিবহন সম্ভব হলে  এমন হবার কোন সুযোগ নেই। এখানে ছোট্ট একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজেই বোঝা সম্ভব, যেমনঃ
স্বল্প গভীরতার (প্রায় চার বা সাড়ে চার ফুট) একটি জাহাজ সারা বছর ধরে যে কোন সময় দেশের রাজধানী ঢাকা বা বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে ২৫০০ টন পণ্য নিয়ে দেশের যে কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে আসতে (যেমন ময়মনসিংহের হালুয়া ঘাট এবং এমন প্রত্যন্ত এলাকা) ট্রাকের তুলনায় প্রায় চার ভাগের এক ভাগ তেল জ্বালিয়ে ৩০/৩৫ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসতে পারে। কিন্তু সড়ক পথে ঐ পরিমাণ মাল বোঝাই নিতে ট্রাক প্রতি ১০ টন হিসেবে ২৫০ টি ট্রাকের প্রয়োজন। এখানে লক্ষ করলেই দেখা যায় এই ২৫০টি ট্রাক চলাচলে সড়কের উপর কেমন চাপ পরছে। এতে যানজট আবশ্যিক ভাবে বাড়ছে।  সড়কের উপর চাপ পরে সড়কের এবং তার ব্রিজগুলোর উপর অহেতুক চাপ পরছে। যা কিনা  নদীপথে বহন করলে এগুলির কিছুই হত না। এমনকি কাক পক্ষীতেও টের পেত না এই এত্ত মালামাল কি ভাবে ও কখন এসে পৌঁছেছে। দেশে উত্পাদিত কোন পণ্যই বিনষ্ট হবার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। উত্পাদনের সাথে সাথে তা পৌছে যাবে যেখানে প্রয়োজন সেখানে।

৫। তবে একথা ঠিক যে একটি ট্রাক সহজেই স্বল্প মূল্যে কেনা সম্ভব কিন্তু একটি জাহাজ তা নয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আমি সরকারের তৎপরতা এবং ব্যাঙ্ক গুলি্র এগিয়ে আসাকে বাধ্যতা মূলক করতে হবে বলে ভাবছি। দেশের আপামর জনসাধারন, বিত্তশালী, দক্ষ প্রকৌশলী, নাবিক সবার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে আপনারা নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী সক্রিয় ভুমিকা নিয়ে এগিয়ে আসুন। নিজের উপার্জিত অর্থ, কৌশল, জ্ঞ্যান, অভিজ্ঞতা ও মেধা নিয়ে বসে থাকবেন না, দেশের ও দশের কাজে লাগতে দিন। একটি সুন্দর আগামী রেখে যান। আমাদের উত্তর পুরুষ যার ফল ভোগ করবে। যেমন আমরা ভোগ করছি আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ফল।

৬। এতে অবশ্যই দেশের স্বাভাবিক উন্নয়ন সহ বেকার সমস্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি, তারুণ্যের সদ্ব্যবহার এবং নানাবিধ শিল্পায়ন অতি স্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি। যেমন হয়েছে গার্মেন্টস শিল্পের সাথে তার আনুষঙ্গিক শিল্প সমূহ। একটা জাহাজ বলতে সাধারণত একটা ছোট শহর বোঝান যায়। কারণ একটা ছোট খাট শহরে যা যা প্রয়োজন হয় একটা সাধারণ মানের জাহাজেও তার প্রায় সবই প্রয়োজন হয়।

৭। এ ধরনের পরিবহনের তাগিদে আমাদের নদীপথের নাব্যতা বজায় রাখতে হবে। যা আমাদের নিজ দেশে তৈরী ড্রেজার দিয়েই সম্ভব হবে। বিদেশ থেকে উচ্চ মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে ড্রেজার আনতে হবে না। এ ছাড়া নদীর নাব্যতা বজায় থাকলে অসময়ে বা অকাল বন্যা ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে না দেশের মাটি, ফসল এবং মানুষের সুখ, আনন্দ কিংবা সম্পদ। সয়ংক্রিয় ভাবে নির্মুল হবে নদী দূষণ। নদীর নাব্যতা সঠিক লেভেলে থাকলে নদী দূষিত হবার কোন উপায় থাকবে না।
৮। এর সাথে আরো থাকছে জাহাজ সংশ্লিষ্ট শিল্প সমূহ যেমন, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ছোট খাট ওয়ার্কশপের লেদ মেশিন, কাটিং মেশিন, ড্রিলিং মেশিন, গ্রাইন্ডিং মেশিন ইত্যাদি। এছাড়া থাকবে নানান নেভিগেশন সরঞ্জাম যা প্রাথমিক ভাবে বিদেশ থেকে আমদানি হবে কিন্তু পরবর্তিতে কোন দিন নিজেদের দেশেই তৈরী সম্ভব হতে পারে। এর পর রয়েছে নানা ধরনের জাহাজের অত্যাবশ্যকীয় জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী, প্রপেলার, নোঙ্গর, শিকল এবং এগুলির সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সামগ্রী। সর্বোপরি মেইন ইঞ্জিন সহ জেনারেটর ও নানা কাজের নানা ইঞ্জিন তো রয়েছেই। আরও আছে জাহাজের নাবিকদের ব্যবহারের জন্য তৈজসপত্র, বিছানাপত্র, আসবাব পত্র, স্যানিটারি সামগ্রী ইত্যাদি নানা কিছু। প্রয়োজন হয় প্রচুর পরিমাণের নানাবিধ রঙ। সবার উপরে রয়েছে জাহাজ তৈরির প্রধান উপকরণ লোহা। প্রাথমিক ভাবে বিদেশ থেকে ক্লাসিফায়েড লোহা না এনেও আভ্যন্তরীণ জাহাজ নির্মাণের জন্য স্থানীয় ভাবে স্ক্র্যাপ দিয়ে নির্মিত প্লেট বা এঙ্গেল কাজে লাগান যেতে পারে। এভাবে যখন এই শিল্পে দেশ পারদর্শিতা অর্জন করবে এবং নিজ দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে রপ্তানি করে বিদেশের সাগর মহা সাগরে ভাসিয়ে দিবে বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ তখন বৈদেশিক মুদ্রার ঝলকানিতে বিদেশ থেকে ক্লাসিফায়েড প্লেট, বিটগার্ডার বা অন্যান্য উপকরণ এনে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মান আর এমন কোন কঠিন ব্যাপার হবার কোন উপায় থাকবে না। যেমনটি করছে ওয়েস্টার্ন ম্যারিন, আনন্দ শিপইয়ার্ড, খান ব্রাদার্স এবং আরও।

৯। আমাদের নৌবহরে থাকবে সাধারন কার্গো জাহাজ, তেলবাহী ও গ্যাস বাহী জাহাজ, মাছ ধরার ট্রলার, গাড়ি বাহী রো রো জাহাজ, পশু বাহী জাহাজ,  ফেরি, নদী খনন কাজের ড্রেজার, নদী পথের ব্রিজ নির্মানের জন্য বা ভিন্ন কোন কাজে ব্যাবহারের বার্জ, নদী পথের ঘাট বা জেটি হিসেবে ব্যবহারের জন্য পন্টুন, রো রো পন্টুন বা এমন অনেক কিছু থাকতে পারে যা আমাদের দেশ প্রচুর পরিমান বৈদেশীক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানী করছে।

১০। কোন দেশ বা জাতির উন্নতির জন্য একবার উপযুক্ত ও সঠিক পথ বেছে নিতে পারলে আর পিছনে ফিরে তাকাবার প্রয়োজন হয় না। যেমন করেছিল জাপান, জার্মান, হল্যান্ড এবং কোরিয়া।
আমাদের না আছে লোক বলের অভাব, না আছে টেকনোলজির অভাব, না আছে একাগ্রতা বা শৃঙ্খলার অভাব। তা হলে আমরা কেন আজই শুরু করতে পারছি না? বাংলাদেশকে পৃথিবীর অন্যতম শিপবিল্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এমন কোন কঠিন বিষয় নয়। সে শুধু সময়ের ব্যাপার। আসুন আমরা সবাই সরকারের কাছে এই আবেদন জানাই যেন তিনি এ দিকে সক্রিয় মনযোগ দেন আর আল্লাহ তা’আলার কাছে জানাই আমাদের মনের আকুলতা যেন তিনি আমাদের সেই সামর্থ দান করেন।

Enhanced by Zemanta

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Shipbuilding in Bangladesh

আমরা কি সত্যিই ঈদে পরিপূর্ণ আনন্দ পাই?

ঈদ মানে আনন্দ বা খুশী। নানা ভাবে মানুষ আনন্দ পায়। শুধু মানুষ কেন প্রকৃতির যে কোন প্রাণীই আনন্দ, দুঃখ কষ্ট, ব্যথা বেদনা ইত্যাদি অনুভব করে। এর নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই। কে কিসে আনন্দ পাবে তা সে নিজেও সঠিক জানে না। স্থান, কাল, পাত্র, সমাজ, সামাজিক অবস্থান, পরিবেশ বা পরিস্থিতির এদিক ওদিকের কারণে নানা জনের আনন্দের সংজ্ঞা ভিন্নতা পেয়ে থাকে। কেউ আনন্দ পায় ভোগ করে কেউ পায় ত্যাগ করে।
কেউ আনন্দ পেতে চায় একা একা কেউ আবার সবাইকে সাথে নিয়ে। যদিও আনন্দ করতে হয় সবাইকে নিয়ে আর দুঃখ করতে হয় নীরবে বা একা একা।
ঈদের আনন্দ মানে রমজানের শেষে সারা মাস সিয়াম সাধনা করে সবাই মিলে ভাল পোশাক পরে ভাল খাবার খেয়ে সুন্দর পরিবেশে সব শত্রুতা, মারামারি, হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আনন্দ করা। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা পারা প্রতিবেশীর  সাথে কিছু সময় কাটানো থেকে কার বাড়িতে কি রান্না করেছে মজার সে সব খেয়ে এবং তার তারিফ করে। এই তারিফ করার মধ্যেও কিন্তু একটা মেকী ভাব অনেক সময় থেকে যায় যা আমরা অনেক সময় লক্ষ করিই না।
ইদানীং দেখছি রমজানের শুরুতেই বা এর আগে থেকেই শুরু হয় কে কোন কোন ধরনের পোশাক বানাবে এবং কি কি রান্না করবে তার এক বিশাল ফর্দ তৈরি হয়ে যায়। কাকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে যাবে, কি করবে এই সব নিয়েই ব্যস্ততা এবং অনেক সময় মান অভিমানের মহড়া চলতে থাকে। অনেকে আবার দেশের বাইরে কোথাও চলে যান বেড়াতে। যেখানে না হয় ঈদের নামাজ আদায় করা, না পাওয়া যায় নিজ দেশের ঈদের চিরাচরিত সনাতনী আবহ বা নিজের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশীর দেখা। ঈদের অর্ধেক আনন্দতো এখানেই নেই হয়ে গেল, তা হলে কি আনন্দ করলাম বুঝি না। অথচ পত্রিকায় নানান ট্রাভেল এজেন্সির নানা রকম চমকদার বিজ্ঞাপন দেখি। সিঙ্গাপুর, নেপাল, থাইল্যান্ড ইত্যাদি নানা জায়গায় যাবার আমন্ত্রণ থাকে তাতে। অবশ্যই অনেকে এমন যেয়ে থাকেন বলেই এই সব বিজ্ঞাপন দেখা যায়। আবার এর বিপরীতে অনেকেই বিদেশ থেকেও তার প্রিয় জনের আসার অপেক্ষায় থাকে। বিদেশেও ওই সময় এয়ারলাইন্সের টিকেটের দাম বেড়ে যায়।
অনেক অমুসলিম দেশে দেখেছি যারা উৎসব বলতে পান করে মাতাল হয়ে পরে থাকাকেই বোঝায়। আমি একবার জরিপ করে দেখেছি কে কতটা পান করেছে। তাতে শুনেছি এক জনে এক ক্রিস্টমাসে ৬৩ পাইন্ট (প্রায় ৩০ লিটার) বিয়ার পান করেছিল। ওদের দেশে এমনটাই হয়ে থাকে। সাধারণ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অর্থাৎ শুক্রবার ও শনিবার রাতে মাতাল হয়ে যখন অসুস্থ হয়ে পরে তখন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে হয়। সমস্ত দায় যেন সরকারের। ওই দুই দিন পুলিশ এবং এম্বুলেন্সের ডিউটি বেড়ে যায়। ইদানীং এ ধরনের উল্লাস নিরুৎসাহিত করার জন্য আইন করে মাতালের চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছে বলে শুনেছি। যাই হোক এরা যা ইচ্ছে তাই করুক আমরা যেহেতু ওই ধাঁচের নই কাজেই আমার বক্তব্য ওদের নিয়ে নয়।

এই যে এত কিছু, এতে কি সত্যিকারে আনন্দ পাওয়া যায়? ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। এই মহা বাক্য সামনে রেখে আমরা আনন্দ যাপনের, উৎসব উদযাপনের কোন ভিন্ন সংজ্ঞা রেখে যাতে পারি কি না সেই ভাবনাই ভাবছি। নানা ছল ছুতায় আমার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে দেশের বাইরে। এইতো প্রায় দশ বছর একটানা বিদেশে কাটিয়ে গত বছর দেশে ফিরেছি। আর ফেরার দুই এক মাস পরেই রমজানের ঈদ। দেশের অবস্থা দেখে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সাথে বাজার দরের তারতম্য দেখে মনে একটু দ্বিধা নিয়ে নেহায়েত এত দিন পর নিজের সন্তানদের তাদের বাবার সাথে ঈদের আমেজ নষ্ট করতে না দিয়ে তাদের স্বাভাবিক চাহিদানুযায়ী ঈদের বাজার করতে বাজারে যেয়ে অনেক দিন আগের এক ঈদের কথা মনে পরে গেল। কেনাকাটা বন্ধ রেখে ওখানেই এক পাশে দাঁড়িয়ে সন্তানদের সেই দিনের গল্প বললাম-
বেশ অনেক বছর আগে আমার এক দরিদ্র আত্মীয়ের বাড়িতে তাদের সাথে ঈদ করতে হয়েছিল এবং সেই ঈদে ও বাড়ির সবার তাদের নিজ পছন্দ মত কাপড় চোপর সহ ঈদের দিনের সব রান্নার বাজার আমি করেছিলাম। দুই দিন আগে ওদের নিয়ে ঢাকার এক মার্কেটে এসে ওদের পছন্দের কাপড় কিনেছিলাম। ওরা প্রথমত বুঝতে পারেনি কি হতে যাচ্ছে। ওদের যখন যার যার পোশাক বাছাই করতে বললাম ওরা বেছে বেছে কম দামের কাপড় বাছাই করছিল দেখে ধমক দিয়ে বলেছিলাম ওগুলি দেখছ কেন? তোমার যা ভাল লাগে, যা সুন্দর লাগে তাই দেখ। শুনে ওদের মধ্যে যে বড় সে একটু আমতা আমতা করে বলেছে, এত দাম! দাম তাতে তোমার কি? তোমাদের যার যা পছন্দ হয় তাই দেখ, টাকা আমি দিচ্ছি। মেয়েদের চুলের ফিতা, ক্লিপ, মেক আপ ইত্যাদি সহ জুতা স্যান্ডেল কিছু বাদ দিইনি। সেদিনের সেই ঈদে ওই বাড়ির ছেলে মেয়েদের আনন্দ মাখা চেহারা দেখে আমার মনে এক স্বর্গীয় অনুভূতি এসেছিল যা আমি আমার সারা জীবনে কোন কিছুতেই পাইনি। এই আনন্দ ওরা সমস্ত জীবনেও দেখেনি, ঈদে যে নতুন কাপড় পরতে হয় তা তারা এই প্রথম আবিষ্কার করেছিল এবং ঈদের দিন নিজ বাড়িতে মাংস পোলাও, বিরিয়ানি, সেমাই রান্না করা যায় তাও ওরা ওই প্রথম দেখেছে।  প্রায় ১৫/১৬ বছর আগের হলেও আজও সে কথা মনে এলে সেই অনুভূতি চোখ বেয়ে দু’ফোটা হিরের টুকরোর মত ঝরে পরে। আমার এই গল্প যদিও আমার সন্তানেরা জানে তবুও সময়ের ব্যবধানে সেদিন যেন আবার নতুন করে ওরা অনুভব করতে শিখল। দুই মেয়ে এক সাথেই বলে উঠল “আব্বু আমাদের জন্য কিছু লাগবে না। আমাদের অনেক আছে, তুমি ওদের জন্য কেন”। শুনে আমার চোখ বেয়ে আবার সেই  অনুভূতি ঝরছিল দেখে আমার ছোট মেয়ে ওড়নার আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে মার্কেটের ভিতরে নিয়ে সেই ওদের জন্য কেনাকাটা করেছিল। নিজ সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পেরেছি দেখে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।
আমাদের মধ্যে যাদের সঙ্গতি আছে সেই আমরা আমাদের জীবনে অন্তত একটিবার কি এমন করতে পারি না? কারো জীবনে যদি অন্তত একটি ঈদের আনন্দ পেতে হাত দুটি বাড়িয়ে দিতে পারি মন্দ কি?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under মানবতা