Category Archives: Adventure

নিয়তি কেন বাধ্যতে?

ট্যংকার ‘নেপচুন’ জাহাজটি ত্রৈমাসিক রুটিন মেইনটেনেন্সের জন্য নিজ কোম্পানি গ্রে ম্যাকেঞ্জির  রিজিওনাল হেড অফিস বাহরাইনের মোহাররেকে নিজস্ব স্লিপ ওয়েতে এসেছে। এটি ব্রিটিশ পতাকা বাহী এবং এর ধারণ ক্ষমতা বার হাজার টন। জাহাজটির পোর্ট অফ রেজিস্ট্রি লন্ডন হলে কি হবে এতে মোটামুটি চার পাঁচটা দেশের নাবিক কাজ করে। এদের সাথে রয়েছি বাংলাদেশের আমি এবং জসীম। আমরা এক সাথে লেখাপড়া করেছি এবং দেশ ছেড়ে দুই জনে এক সাথে রয়েছি বলে স্বাভাবিক ভাবে অন্তরঙ্গতা বা
ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি। স্লিপ ওয়েতে সাধারণত ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই জাহাজের বটম, প্রপেলার, রাডার চেক করা আর টুকি টাকি যা মেরামত কাজ থাকে সেগুলি সেরে পাশের সিতরা ট্যাংকার বার্থ থেকে লোড নিয়ে ভিন্ন কোন বন্দরে চলে যাই।

এবার প্রথম যে দিন সকালে এখানে এসেছি সে দিন স্লিপ ওয়ের লোকজনেরা আমাদের ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন বার্কির দেয়া লিস্ট অনুযায়ী জাহাজের মেরামত কাজ করছে। সারা দিন আমরা জাহাজের নাবিকেরা সবাই যার যার কাজ অনুযায়ী ওদের দেখিয়ে দিচ্ছি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছি।
বিকেলে কাজকর্ম সেরে মানামা যেতেই হবে। ওখানে একটা দোকানে দারুণ সিঙ্গারা বানায়। এক শ ফিলসে একটা কাগজের প্লেটে চারটা সিঙ্গারা  আর তার সাথে যে চাটনি সেও দারুণ। তবে কোন পানি নেই, পানি খেতে হলে আলাদা সফট ড্রিঙ্কস কিনে নিতে হবে। জাহাজ যখনই এই ছোট্ট মুক্তা দ্বীপের দেশ বাহরাইন আসে তখনই আমাকে ঐ সিঙ্গারার লোভে মানামা যেতেই হবে। কখনো শোর লিভ না পেলেও ক্ষতি নেই। অন্য যেই যাক তাকেই বলে দিতাম আমার জন্য সিঙ্গারা নিয়ে এসো। এক বার এক এক করে পাঁচ প্লেট খেয়েছিলাম। আজও সে কথা মনে হলে হাসি পায়। জাহাজে শুধু মাত্র বাংলাদেশি রান্না বাদে নুন মরিচ মশলা ছাড়া পাঁচ মিশেলি যেমন কখনো ইংলিশ, কখনো  ইটালিয়ান কিংবা গ্রীক। এই সব রান্না খেয়ে কি আর বাঙ্গালির মন ভরে? তাই যখন এই উপ সাগরের পাড়ে যেখানে জাহাজ যায় খুঁজে বেড়াতাম কোথায় বাংলাদেশি বা ভারতীয় বা নিদেন পক্ষে পাকিস্তানি রেস্টুরেন্ট আছে। অবশ্য অনেক দিন যাতায়াত করতে করতে আমাদের জানা হয়ে গিয়েছিল কোথায় কি আছে। জাহাজ থেকে শোর লিভ পেলেই নুন মরিচের স্বাদের আশায় ছুটে যেতাম ওই সব রেস্টুরেন্টে।
যাক, যা বলছিলাম। এবার প্রথম দিন বিকেলে বাইরে যাবার জন্য জসীমকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজের গ্যাং ওয়েতে এসে নিচে নামার সিঁড়ির রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছি এমন সময় ক্যাপ্টেন পিছন থেকে ডাকল। ফিরে দাঁড়ালাম। শোন, ওই যে ডেকের উপরের ব্রিজের নিচ দিয়ে যে পানির লাইনে লিক হয়েছিল তুমি ডেভকন দিয়ে মেরামত করেছিলে মনে আছে? হ্যাঁ থাকবে না কেন, এইতো সেদিনের কথা। তা হলে কাল ওয়ার্কশপের লোকজনেরা আসার আগে ওই ডেভকনের প্রলেপ সরিয়ে দিও যাতে ওটা ওয়েল্ডিং করে নেয়া যায়। আচ্ছা ঠিক আছে কাল সকালেই করে ফেলব। বলে নেমে গেলাম। যাবার পথে জসীমের সাথে নানা ধরনের গল্প। ওর ভয়েজ শেষ করে দেশে ফেরার সময় হয়ে গেছে কিন্তু ও চাইছে আরও কিছু দিন থেকে আরও কিছু ডলার সাথে নিয়ে যেতে। ওকে বোঝাবার চেষ্টা করছি দেরি করে কি হবে তার চেয়ে তুই এবার চলে যা, আবার না হয় তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি! ওদিকে তোর বৌ অপেক্ষা করছে। না, ও কথা সে মানছে না। যাক, না মানলে আমি কি করব? আমার যেতে অন্তত আরও মাস খানিকের মত দেরি আছে। ও জানে কিন্তু তবুও আমাকে বলল তুই চলে যা। আরে আমি কি করে যাই? আমার আরও দেরী আছে না?
সে দিন আগের মতই মানামা থেকে সিঙ্গারা খেয়ে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাতে একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে খেয়ে জাহাজে ফিরে এসে শুয়ে পরলাম।

পর দিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ডেকে গেলাম। শুকনো ডেভকনের আস্তর তোলার জন্য চিপিং হ্যামার এনে যেই প্রথম বারিটা দিলাম আর ওমনিই ডেভকনের একটা বিরাট টুকরো এসে আমার ডান চোখে আঘাত করল। সে কি যন্ত্রণা! মনে হচ্ছিল এই বুঝি জীবনের শেষ। সমস্ত পৃথিবী এক ঝলক করে নানা রঙ্গে রঙ্গিন হয়ে উঠল। রঙ গুলো আসছে যাচ্ছে। ভাবছি, আমি বুঝি মরে যাচ্ছি। শুধু একটা চিৎকার দিতে পেরেছিলাম। এই মনে আছে। আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন দেখি আমার পাশে সাদা পোশাক পরা এক জন ইন্ডিয়ান নার্স দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কবরের ভিতরে এই মানবী এলো কেমন করে?সেও আবার আমার দেশের মেয়েদের মত চেহারা! দুনিয়ার কাজ কর্মের হিসেব নিবে না কি করবে বুঝে উঠতে পারছি না। অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে ওই ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্র মহিলা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল এখন কেমন লাগছে? এ কি!  এ দেখি আবার মানুষের মতই ইংরেজিতে কথা বলছে। ফেরেশতারা কি এমন হয়, ইংরেজিতে কথা বলে? কিন্তু দুনিয়াতে শুনেছি ফেরেশতারা আরবিতে কথা বলে। তাহলে? পাপ পুণ্যের কিছু জিজ্ঞেস করছে না কেন? তাহলে এ কি ফেরেশতা নয়? আবার জানতে চাইল, কেমন লাগছে? এ্য, এটা কোন জায়গা? এটা বাহরাইন জেনারেল হাসপাতাল। আমি এখানে কেন? তোমার  চোখে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। শোনার সাথে সাথে অনুভব করলাম আমার ডান চোখে ব্যান্ডেজ। সম্ভবত কোন আঘাত পেয়ে তুমি সেন্স লেস হয়ে গিয়েছিলে। ডাক্তার এক্স রে করে তোমার ডান চোখ অপারেশন করে মণির ডান পাশ থেকে প্রায় তিন মিলিমিটার ডিপ থেকে লোহার মরিচার গুড়া বের করেছে। কি হয়েছিল? এই এতক্ষণে সব কিছু একটু একটু মনে পরছে। আমি ক্যাপ্টেনের নির্দেশে ডেকের উপর দিয়ে ফোর ক্যাসেলে যাতায়াতের পথের নিচের পানির লাইন থেকে ডেভকন তুলছিলাম। কি একটা যেন ছুটে এসে আমার চোখে আঘাত লাগল। এরপর আর কিছু মনে পরছে না। মনে করার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই পারছি না। নার্স আবার জানতে চাইলে যা মনে পরেছে তাই বললাম। শুনে খুব আফসোস করল। সিথানের পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর সান্ত্বনার কথা বলছে। তোমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে যে চোখের মণিতে লাগেনি। চোখটা রক্ষা পেয়েছে, কয়েক দিনেই ভাল হয়ে যাবে চিন্তা করো না এখন এই ওষুধটা খেয়ে নাও। সেই সকাল থেকে এমনি রয়েছ,  আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।

বিকেলে ক্যাপ্টেন ই বার্কি, জসীম এবং আরও কয়েক জন এলো। জসীম বলল আমি তোমার চিৎকার শুনেই দৌড়ে কাছে এসে দেখি তুমি ডেকে পরে রয়েছ পাশে চিপিং হ্যামার। তোমাকে তুলে দেখি পকেটে প্রায় চার ইঞ্চি সাইজের একটা পুরু ডেভকনের টুকরো। ওই দেখেই বুঝলাম ওটা তোমার চোখে লেগেছে। সেফটি গ্লাস পরে নাওনি কেন?যাই হোক তাড়াতাড়ি ক্যাপ্টেনকে জানালাম উনি সাথে সাথে ওয়ার্কশপের গাড়িতে করে তোমাকে নিয়ে এই হাসপাতালে এলো। সাথে আমি আর ড্যানি এসেছিলাম। ইমার্জেন্সীতে নিয়ে সাথে সাথে এক্স রে করে দেখে অপারেশন করে এখানে নিয়ে এলো। আমরা সবাই ছিলাম। তোমার জ্ঞান ফিরছে না বলে এই নার্স এখানেই ছিল। বেশ অনেকক্ষণ থেকে ওরা চলে গেল। এর পর থেকে পালা করে কয়েক জন নার্স ডিউটি করেছে। বেশ যত্ন করছিল সবাই। গোসল করা যাবে না বলে গরম পানিতে শরীর মুছে দেয়া থেকে সময় মত খাবার এবং ওষুধ খাওয়ানো সব কিছু। শুধু টিভি দেখতে বা কোন পত্রিকা পড়তে দেয়নি।  তারপর দিন বিকেলে আবার জাহাজ থেকে কয়েক জন এলো। ওদের সাথে আমাদের এই স্থানীয় অফিসের ক্রু সুপার ক্যাপ্টেন রামস বটম এলো। এ দেশে হাসপাতালে রুগীর জন্য বাইরে থেকে কোন খাবার দাবার বা ফুল বা কোন কিছুই সাথে করে নিয়ে আসার কোন নিয়ম নেই। সে দিন যাবার সময় ক্যাপ্টেন বার্কি বলল জাহাজের মেরামত হয়ে গেছে, আমরা কাল সকালে সিতরা থেকে লোড নিয়ে দোহা যাব। ক্যাপ্টেন রামস বটম বলল তুমি এখানেই থাকবে, সুস্থ হলে পরে তোমাকে হোটেলে পাঠিয়ে দিব। জাহাজ থেকে তোমার পাসপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি। ইমিগ্রেশনে এন্ট্রি করিয়ে নিয়েছি। পরে তোমার জাহাজ কোথায় থাকে সেই অনুযায়ী জাহাজে যাবার ব্যবস্থা করা যাবে। আমার চিন্তিত মুখ দেখে বলল, ডোন্ট ওরি মাই বয় আই উইল বি হেয়ার। আমি প্রতি দিন এক বার এসে তোমাকে দেখে যাব। আমি বললাম আমার ভাল লাগছে না আমি বাড়ি যাব। আচ্ছা ঠিক আছে দেশে যাবে, তবে এমন শরীরে জার্নি করবে কি করে? একটু সুস্থ হয়ে নাও তখন যেও।

চার পাঁচ দিনের মধ্যে সুস্থ হলে  আমার অফিসের গাড়ি এসে হোটেল মানামায় নিয়ে গেল। হোটেলে তিন চার দিন থাকার পর এক দিন সকালে অফিস টাইমে ফোন এলো। ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান মুর্থি কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বলল তোমাকে আবুধাবি যেতে হবে, কাল তোমার ফ্লাইট। গাড়ি পাঠাচ্ছি অফিসে এসে তোমার টিকেট আর পাসপোর্ট নিয়ে যাও। অফিসে যেয়ে মুর্থির সাথে দেখা না করে সরাসরি রামস বটমের রুমে চলে গেলাম। আমি আবুধাবি যাব না, আমাকে দেশের টিকেট করে দাও। আচ্ছা ঠিক আছে তোমার কথা আমার মনে আছে। আপাতত তুমি ওখানে যাও, আমি চিটাগাং এ এজেন্টের কাছে তোমার রিলিভার এর জন্য টেলেক্স পাঠিয়েছি কেউ এক জন এলেই তোমাকে পাঠিয়ে দিব। আচ্ছা ঠিক আছে বলে ধন্যবাদ জানিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এবার মুর্থির রুমে এলাম। কিছুক্ষণ কেমনে কি হল এসব নিয়ে আলাপ করে চা খাইয়ে টিকেট পাসপোর্টের খাম দিয়ে বলে দিল কাল বিকেলে ড্রাইভার তোমাকে এয়ারপোর্টে দিয়ে আসবে। আবুধাবিকেও বলে দিয়েছি তুমি ওখানে পৌঁছে অফিসে ফোন দিলেই ওরাও গাড়ি পাঠাবে। আচ্ছা গুডবাই বলে চলে এলাম।

আবুধাবি পৌঁছে এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি জাহাজে এসে দেখি ওরা তেল আনলোড করে জেটিতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ওঠার পরেই লোড নেয়ার জন্য সউদি আরবের রাস্তানুরাহ এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিল। এই ভাবে কয়েকটা ট্রিপ পরেই এক দিন  দুবাই থেকে কুয়েত যাবার পথে ক্যাপ্টেন জানাল আগামী সপ্তাহে তোমার রিলিভার আসছে। খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। হাতের কাছে যা ছিল তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়ার ব্যস্ততা শুরু হল। আবুধাবি যাবার পর টিকেট পেতে দুই এক দিন সময় লাগবে তখন কিছু কেনা কাটা করে নিব। যদি দুবাই থেকে ফ্লাইট হয় তাহলে ভাল হবে। এখানে সব কিছুর দাম কম। কুয়েত থেকে লোড নিয়ে আবার আবুধাবি পৌঁছাতে এক সপ্তাহ লেগে গেল। আবুধাবি পৌছার দুই দিন আগেই জাকির এসে দুবাইর এক হোটেলে থাকছে। গ্রে আবুধাবি (আমাদের কোম্পানিকে রেডিওতে ডাকার নাম) জানিয়েছে। জুলাই মাসের ২২ তারিখ সকালে আবুধাবি পৌঁছে সরাসরি জেটিতে ভীরে দেখি জাকিরকে নিয়ে এজেন্ট অপেক্ষা করছে। আমি আগেই রেডি হয়ে ছিলাম। জাকির জাহাজে ওঠার পর আমার সাইন অফ করে আমার পাসপোর্ট দিয়ে দিল। সাথে চিটাগাং এর এজেন্টকে দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেনের লেখা একটা চিঠি। জসীমের কাছে বিদায় নিয়ে ব্যাগ সুটকেস সহ নেমে এজেন্টের সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি জসীম করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা কেন যেন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। মনের অবচেতনা  থেকে একটা প্রশ্নের উদয় হল। জসীম, আবার কি দেখা হবে? নিজেকে ধমক দিলাম, কি সব ভাবছ? কেন দেখা হবে না? গাড়ি চলতে শুরু করেছে। একটু পরেই একটা বিশাল শেড এর আড়ালে চলে গেলাম। ওরা এখন জাহাজ ছেড়ে আবুধাবির অফ শোর মুরিং এ যেয়ে তেল আনলোড করবে। আর সেই তেল গিয়ে পৌঁছাবে অফ শোর থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে “আবুধাবি ন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানি” বা এডনকের ট্যাঙ্কে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে দুবাই পৌঁছে জাকির যে হোটেলে ছিল ওখানেই আমাকে নামিয়ে দিল। যাবার সময় ড্রাইভার বলে গেল তোমার টিকেট হলে অফিস থেকে জানাবে, তখন এসে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাব। ওকে ইব্রাহিম, বাই!
ইব্রাহিম চলে যাবার পর হোটেলের কাউন্টারে গেলাম। আমাদের এই গ্রে মেকেঞ্জি ম্যারিন সার্ভিস কোম্পানির যত সিম্যান এই দুবাই দিয়ে আসা যাওয়া করে তার সবাই এই হোটেলেই থাকে। এখানকার সবই আমাদের চেনা। অফিস থেকে আগেই হোটেল ম্যানেজারকে জানিয়ে রেখেছিল। রিসিপশনের খাতায় নাম ধাম লিখে আমার হাতে ৬ তলার একটা রুমের চাবি দিয়ে বলে দিল “হ্যাভ এ নাইস টাইম হেয়ার”।
দুপুরে খাবার পর বের হয়ে সোজা বার দুবাই মার্কেটে চলে গেলাম। দেশে যাচ্ছি বলে কিছু কেনা কাটা করব। হাতে যা ডলার ছিল সেগুলি সব ভাঙ্গিয়ে যা যা মনে ধরল কিনে নিলাম। কিনে দেখি এখনও বেশ কিছু দিরহাম পকেটে রয়ে গেছে। আচ্ছা ঠিক আছে কাল আবার আসব। কাল সকালে একবার দেরা তে অফিসে যাব দেখি টিকেটের কি করেছে জেনে আসব আর হিসেব নিকেশ করে কত ডলার বাকী আছে তা যদি দিয়ে দেয় তা হলে নিয়ে আসব। একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেলের ভিতরে ঢুকে লাউঞ্জ পার হয়ে রিসিপশনের পাশ দিয়ে লিফটে উঠবো বলে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছি আর অমনি রিসিপশনের ইন্ডিয়ান জন একটু উত্তেজিত ভাবে ডাকল
এই এদিকে আস, তোমার একটা জরুরী ম্যাসেজ আছে!

এগিয়ে গেলাম।
কি খবর জন?
তুমি কি জান যে তোমাদের নেপচুনে আগুন লেগেছে?
শুনেই বুকটা ধক করে উঠল। জসীম, জাকিরের চেহারা মনের পর্দায় ভেসে উঠল।
কি বলছ জন?
হ্যাঁ তুমি বেরিয়ে যাবার পর তোমাকে জানাবার জন্য তোমাদের অফিস থেকে ফোন করেছিল।
বল কি?
হ্যাঁ তুমি তোমার অফিসে ফোন করে জেনে দেখ। বলেই ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। ওদের ফোন বুক বের করে আমাদের গ্রে মেকেঞ্জির ফোন নম্বর বের করে দিল। নম্বর ঘুরিয়ে রিসিভার কানে নিয়ে রিং টোন শুনছি আর বুক ঢিব ঢিব করছে ‘আল্লাহ জন যা বলছে তা যেন সত্যি না হয়!’ ওপাশ থেকে ইন্ডিয়ান স্টেনলির কণ্ঠ চিনতে পারলাম।
হ্যালো স্টেনলি, নেপচুনের কি হয়েছে?
আমি খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে নেপচুন ইজ ডেড এন্ড মস্ট অফ দি ক্রুজ আর ইন হসপিটাল এন্ড মোর ওভার সাম আর ডেড।
কি করে হল?
সংক্ষেপে সব বলল। সাথে যারা জীবিত আছে তারা আবুধাবির কোন হাসপাতেলে আছে বলে দিল।
আমি কি এখন ওখানে যেতে পারি?
না এখন পারবে না, কাল সকালে যেও।
বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল। আমার হাত থেকে কখন রিসিভার নামিয়ে রেখেছি না কি জন নিয়ে রেখেছে বলতে পারছি না। মনে একটা প্রচণ্ড ঝড় বইছে। জসীম আর ওর নতুন বৌ মল্লিকার চেহারা মনে ভাসছে। আজ সকালেই মাত্র জাকির এসেছে। ওর হাসি খুশি চেহারা মনের পর্দায় ভেসে এলো। আমাকে দেখেই বলেছিল যান, আপনার জন্য ঢাকা শহর সহ পুরো বাংলাদেশ রেখে এসেছি। নিজেকে অসম্ভব অসহায় মনে হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি কেন শপিং করতে গেলাম  বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কি হল? জসীমের কি হয়েছে? ওকি বেচে আছে না কি? সেকেন্ডে কয়েক হাজার মাইল বেগে মনের আকাশে অসংখ্য প্রশ্নের ধারা বয়ে গেল। কিছু ভেবে পাচ্ছি না। এখন কি করব? দুবাই থেকে ট্যাক্সিতে আবুধাবি গেলেও দেড় ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু এখন ওখানে যেয়েও কিছু হবে না। কাউকে দেখতে পাব না, কিছু জানতে পারব না। অনেকক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কোন বোধ নেই। জন ডেকে লাউঞ্জের একটা সোফা দেখিয়ে বলল ওখানে একটু বস। চিন্তা করে কিছু হবে না। কাল সকালে আবুধাবি গিয়ে দেখ।
সোফায় বসলাম। জন রিসিপশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আসা যাওয়ার পথে দুবাই এলে এই হোটেলে থাকি বলে প্রায় সবার সাথে বেশ আলাপ আছে। ওর কথা কিছু কানে ঢুকছে অধিকাংশই ঢুকছে না। বুঝতে পারছি। জাকির যদি আর মাত্র কয়েকটা দিন পরে আসত কিংবা জসীম যদি আমার আগে চলে যেতে চাইত তা হলে আমি নিজেই ওই জাহাজে থাকতাম। “নেপচুন ইজ ডেড” বারবার স্টেনলির এই একটা কথাই শুধু মনের আকাশে কাল মেঘের মত ছেয়ে আছে। এ কথার মানে কি তা আর কেউ না জানলেও যারা নাবিক, সাগরে ভেসে যাদের জীবন কাটে তারা খুব ভাল করেই জানে।

মানুষ নিজেই জানে না তার নিজের একটা অসম্ভব সুন্দর এবং কার্যকর গুণ আছে। আর তা দিয়ে যত রকমের বিশাল বা ক্ষুদ্র মনের আঘাত এক সময় ভুলে যেতে পারে। মনের উপরে ভুলের একটা প্রলেপ দিয়ে দেয়। যেমন পারে নিজের সন্তানের অকাল মৃত্যু যন্ত্রণা, মায়ের সাধ না মিটিয়ে তাকে কবরে রেখে আসার ব্যথা

কিংবা প্রিয়তমর হঠাৎ করে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার হাহাকার। তেমনি একটা গুণ বোধ হয় আমারও আছে আর তাই সম্ভবত এক সময় যে কোন ভাবেই হোক আমিও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লিফটে করে উপরে চলে গেলাম।
সারা রাতে ঘুম আসেনি। বারবার জসীম, জাকির, মাত্র গত ভয়েজের শেষে বিয়ে করা জসীমের নতুন বৌ মল্লিকা আর আমার অবস্থান নিয়ে একটি করুণ বিষাদে ভরা চলচ্চিত্র দেখেছি। যার পরিচালক নিয়তি স্বয়ং। অভিনয় করেছি আমরা এই কয়েক জন এবং আশে পাশে ছিল আরও কয়েক জন। তাদের এক জন হচ্ছে এমন এক জন যার সাথে এই ভয়েজের শেষে দেশে যাবার পরে আমার সাথে সারা জীবনের জন্য একটা মধুর সম্পর্ক হবার কথা গুরু জন মহলে ঠিকঠাক হয়ে আছে।
কি হবে এই সম্পর্কে? এই তো জসীম কত গুলি বছর ধৈর্য ধরে কত অপেক্ষা করে কত বাধা বিপত্তি এড়িয়ে মল্লিকাকে নিয়ে এলো। আজ কোথায় মল্লিকা আর কোথায় জসীম? মল্লিকা কি জানতে পেরেছে? ওর এত প্রতীক্ষার জসীম এখন কোথায়? গ্রে ম্যেকেঞ্জি টেলেক্স পাঠাবে চিটাগাঙের এজেন্টকে। ওই টেলেক্স পেয়ে চিটাগাঙের এজেন্ট টেলিগ্রাম পাঠাবে জসীমের বৌ মল্লিকাকে। তাতে অন্তত তিন থেকে চার দিনের আগে মল্লিকার এ সংবাদ জানার কথা নয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? মল্লিকা কি স্বপ্নে কিছুই দেখেনি? তার হাত থেকে কি কিছু ছুটে পরে যায়নি? হাটার পথে কি কোন হোঁচট খায়নি? কিংবা মল্লিকার বুকের ভিতরে লুকান জসীমের জন্য ভালবাসার যে স্বপ্ন সরোবর রয়েছে সেই সরোবরে কি উথাল পাথালি কোন ঢেউ ওঠেনি? নিশ্চয় টেলেক্স টেলিগ্রামের ধাঁধা ডিঙ্গিয়ে মল্লিকার লুকান সরোবরে এতক্ষণে উত্তাল প্রলয়ঙ্করী কোন ঢেউ  আছড়ে পরছে। মল্লিকা কি ধারনাও করতে পারছে এই ঢেউয়ের মানে কি?

তা হলে আমি কেন এই কণ্টক  বিভীষিকা  এবং পায়ে পায়ে বিপদের হাতছানি জড়িত জীবনের সাথে তাকে জড়াব? তাকে কি জানাব জসীম মল্লিকা জাকিরের কথা? এ সব কথা জেনে সে কি আমাকে সহজেই বরণ করে নিবে? তার মনে কি দ্বিধা থাকবে না? তা হলে কি হবে, কি হবে ভেবে ভেবেই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেমন করে চলে গেল কিছুই বুঝলাম না। ভোরের আজানের সুরে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে পাশের দরজা খুলে বারান্দায় চেয়ারে বসলাম। অনেক দূরের মরু পাহাড়ের উপর দিয়ে সূর্যের লাল রশ্মি চিক চিক করে উপরে উঠে আসতে চাইছে কিন্তু কি জানি মল্লিকার কথা ভেবে হয়ত সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। বেশ অনেক ক্ষণ তাকিয়ে থেকে এক সময় ভিতরে এসে সকালের কাজ কর্ম সেরে কাপর পরে নিচে এসে রিসিপশনে বলে হোটেল ছেড়ে এলাম। ভাগ্য ভাল, সাথে সাথেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে সোজা আবুধাবির ওই হাসপাতালে চলে এলাম।
রিসিপশনের লোকদের আমার পরিচয় জানালাম। সাথে আরও বললাম, ওখানে আমিও থাকতে পারতাম কিন্তু নিতান্ত নিয়তির অনিচ্ছা ছিল বলে থাকা হয়নি। শুনে ওরা আফসোস করল, ভেরি স্যাড! এক জন আমাকে ডান বাম ইত্যাদি বলে লিফট দেখিয়ে দিল। লিফট বেয়ে ওদের ডান বাম অনুযায়ী ৩২ ডি নম্বর রুমে ঢুকে দেখি জাকির শুয়ে আছে। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু ব্যান্ডেজ। নার্সকে বললাম, পাশের টুল দেখিয়ে বসতে বলে ডাকতে নিষেধ করল। ঘুম ভাঙলে কথা বলতে বলল। অপেক্ষা করছি। রুমের বাইরে এসে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম অন্য যারা ছিল তারা কোথায়? নার্স রুম ছেড়ে পাশের রুম থেকে একটা টাইপ করা কাগজের ফটো কপি এনে হাতে দিল। পড়ে দেখলাম পাঁচ জন স্পট ডেড। তার মধ্যে জসীমের বিকৃত ডেড বডি পাওয়া গেছে বাকী কারো কোন চিহ্নই পায়নি। এডনকের যে পাইপ ফিটার ছিল তাকেও পাওয়া যায়নি। হয়তবা কোন হাঙর বা কোন সামুদ্রিক জীবের ক্ষুধার খাদ্য হয়েছে কি না কে জানে? এই হাসপাতালে বার জন চিকিৎসায় আছে।

প্রায় ঘণ্টা খানিক পরে জাকির চোখ মেলে তাকিয়েছে। দেখে পাশে দাঁড়ালাম।  আমার দিকে হাসি কান্না সব কিছু ভুলে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে ওর কোন বোধ বিকার কিছুই নেই। আমাকে চেনার কোন লক্ষণ দেখছি না। কি হয়েছে বা ও কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। ওর সাথে আমিও কিছুক্ষণ ওর  দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু এ ভাবে কতক্ষণ? মিনিট দশেক পরে ডাকলাম, জাকির! কেমন আছ জাকির? মনে হল কিছুটা সম্বিত ফিরে পেয়েছে। ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে গেল, বুঝে আমার মনেও আঘাত লাগল। মাত্র এই, এই টুকু সময়ের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল। কাল সকালেই যাকে দেখেছি ফুরফুরে বাতাসের মত হাসছে।  আজ তার এ কি চেহারা! শুধু কাল সকালে কেন, বিগত ৭/৮ বছর ধরেই দেখছি যে জাকির কখনও মুখ ভার করে থাকেনি। আস্তে আস্তে ওর চোখ দুটি ভিজে আসছে। গায়ে মাথায় কোথাও হাত দেয়ার উপায় নেই। শুধু ব্যান্ডেজ। অনেকক্ষণ কাঁদল।  কিছু বলতে পারলাম না, কোন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু ঠোট নড়ল দেখে বুঝলাম হয়ত কিছু বলতে চাইছে। ওর ঠোটের কাছে কান এগিয়ে আনলাম। নিস্তেজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ভাই, আপনি কি ভাবে জানলেন? এখানে এলেন কি ভাবে? বললাম সব কিছু। কি হয়েছিল জাকির? শুনেই আবার কান্না। কাঁদার সুযোগ দিলাম। কান্নার পানিতে যদি দুঃখ কষ্ট গুলি ধুয়ে ফেলতে পারে। কাঁদুক, ও যতক্ষণ পারে কাঁদুক।
প্রায় আধা ঘণ্টা পর একটু শান্ত হলে আবার জিজ্ঞেস করলাম। তখন অতি নিচু কণ্ঠে যা বলল:

আমাকে নামিয়ে দেয়ার পর ওরা অফ শোর বয়াতে মুরিং করে সাগর তলা থেকে তেলের পাইপ তুলে মুখে লাগান ঢাকনা খুলে লাইনের তেল বের হয়ে যাবার অপেক্ষা করছে। সমস্ত জাহাজ পেট্রোলের গ্যাসে ভরে গেছে। জাকির, জসীম আর ইরানি জাবের জাহাজের পিছনের ডিসচার্জিং লাইন এডনকের যে লোকটা খুলছে তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে এমন সময় পাকিস্তানি কুক হেলপার আরাফাত গ্যালিতে (কিচেন) ঢুকে গ্যাসের চুলা জ্বালাবার জন্য দিয়াশলাই জ্বালাবার সাথে সাথেই আগুনের শিখা মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত জাহাজে ছেয়ে গেল। জসীম ভাই চিৎকার দিয়ে পরে গেল জাবেরও ওই ভাবে একটা চিৎকার দিয়ে কি হল জানি না আমি আর কোন উপায় না দেখে পাশের বয়াটা নিয়ে পানিতে ঝাপ দিলাম কিন্তু ঝাপ দেয়ার সময় লক্ষ্য করলাম এতক্ষণে এডনকের পাইপ দিয়ে যে তেল পরে পানিতে ভাসছিল তাতে আগুন ছড়িয়ে গেছে এবং আমি ওই আগুনের মধ্যেই নামছি। চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বয়া ধরে সাঁতরাতে পারব না। যতক্ষণ পারা যায় ডুব দিয়ে থেকে শ্বাস নেয়ার জন্য হাত দিয়ে উপরের পানি সরিয়ে মাথাটা কোন ভাবে উঠিয়ে শ্বাস নিয়ে আবার ডুবে থাকতে হবে। কিন্তু পানিতে পরার একটু পরেই আমার হাত থেকে বয়াটা ছুটে গেল। এর মধ্যে পানিতে নামার সাথে সাথেই সমস্ত শরীর পুরে গেছে বুঝতে পেরেছি, শরীরে জ্বালা করছে।  সাগরের নোনা পানির জন্য চোখ খুলে কিছু দেখতে পারছি না। হাত পুরে গেছে। সাঁতরাতে পারছি না। শেষ যখন হাতে বয়া ছিল তখন দেখেছিলাম যেখানে জাহাজ ছিল তার আশে পাশে আগুন আর আগুন। জাহাজের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু আগুন। এডনকের পাইপ ফিটারদের যে বোট ছিল ওরা যে কখন বোট নিয়ে সরে পরেছিল জানি না। ওরাই ওয়ারলেস দিয়ে শোর অফিসে সংবাদ দিয়ে ওই আগুনের মধ্যেই কিছুক্ষণ ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার দিয়ে ফোম ছিটিয়ে ছিটিয়ে যাকে যাকে দেখেছে তাদের তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে আবুধাবি হারবার থেকে ফায়ার ফাইটিং টাগ আসতে দেখেছি। এর পর আমার আর কিছু মনে নেই।
আমাকে জিজ্ঞেস করল
জসীম ভাই কোথায়? আমি কোন জবাব দিতে পারিনি। শুধু এটুক বলেছিলাম অন্য কেবিনে আছে।
আপনার টিকেট হয়েছে?
না এখনও অফিসে যাইনি। আজ সকালে যাব ভেবেছিলাম কিন্তু কাল রাতে তোমাদের এই সংবাদ জেনে আজ অফিসে না যেয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এখানে চলে এসেছি।

এর দুই এক দিন পরেই আমার টিকেট হয়ে গেল। মনের মধ্যে একটা গভীর টান থাকা ষত্বেও বিদেশের নানা জটিলতার জন্য আর আবুধাবিতে  জাকিরকে দেখতে যেতে পারিনি। দুবাইতে অফিস, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি নানা ঝামেলা সেরে বিষণ্ণ মনে যখন দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে টেক অফ করার পর  সিট বেল্ট বাধছিলাম তখন সেই শ্লোকটি ভাবছিলাম, “নিয়তি কেন বাধ্যতে?”। একটু পরে ব্রিটিশ এয়ারলাইন্সের প্লেন দুবাইর মাটি ছেড়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল তখন জানালা দিয়ে ফেলে আসে জসীমের নিশ্চিনহ দেহ, জাকিরের করুণ দৃষ্টি আর কল্পিত মল্লিকার হাহাকারের কথা ভেবে কেমন যেন পাথরের মত বসে বসে দেখলাম।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Adventure

সাগর তলে রূপনগর

বাহরাইন সিতরা ট্যাঙ্কার বার্থ থেকে বৃটিশ পতাকাবাহী ট্যাঙ্কার জাহাজ “কুইন অফ গালফ” এ ফুল লোড অর্থাৎ প্রায় ষোল হাজার টন হাই স্পিড ডিজেল নিয়ে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে শীতের কোন এক সন্ধ্যা বেলায় আমরা ওমানের মাস্কাট বন্দরের দিকে সেইল করেছি। মাত্র দুই দিন এক রাতের পথ। জাহাজ স্বাভাবিক গতিতে আরব্য উপসাগর দিয়ে এগিয়ে চলছে। এই সময় সাধারনত এখানে সাগর উত্তাল থাকে তবে আজ সেইল করার সময় সাগর কিছুটা শান্ত ছিল বলা যায়। কিন্তু সেইল করার পর দিন ভোর থেকেই লক্ষ্য করছি আমরা যতই এগুচ্ছি ঢেউ এর উচ্চতা আস্তে আস্তে ততই বাড়ছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে জাহাজের রোলিংও বাড়ছে। জাহাজে চাকরি করার অনেক সুবিধা যেমনঃ নানা দেশ দেখা যায়, তার সাথে নানা জাতির মানুষের সাথে মেশা যায়। জানা যায় তাদের জীবন যাত্রার ব্যবস্থা। পাশাপাশি কিছু অসুবিধা বা এক কথায় বলা যায় একটা দুঃসহ যন্ত্রণা রয়েছে আর তা  হচ্ছে এই রোলিং। অনেকেই রোলিং মোটেই সহ্য করতে পারে না। কাউকে এমনও বলতে শুনেছি যে, এই ভয়েজ শেষ হলেই আর আসব না। দেশে ফিরে গিয়ে পানের দোকান দেব তবুও  এই রোলিং আর না। কিন্তু হলে কি হবে, সাগরের হাতছানির নেশায় যে একবার ডুবেছে তাকে যে আবার, বারবার সাগরের বুকে ফিরে আসতেই হবে। সাগরের যেন কেমন একটা মায়া রয়েছে। যে মায়াজালে সে সবাইকে আটকে ফেলে। সাগরের বুকে গাং চিলেদের নিঃশব্দে নীলাকাশে ওড়া, মাঝে মাঝে ডলফিনের ঝাকের জলকেলি, খোলা নীল আকাশ, নীল আকাশের নিচে নীল সাগরের নীল ঢেউ, ঢেউ এর চূড়ায় মুক্তার মত সাদা ফেনার লুকোচুরি মানুষের মনকে উদ্ভ্রান্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যায়। কোথায় যে সে হারিয়ে যায় সে নিজে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। যখন নীল ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে কিংবা সাগর পাড়ে আছড়ে পরে সে এক মায়াবী দৃশ্য। একটা মনকাড়া মোহ। এই মোহজাল কেউ ছিঁড়ে বের হতে পারে না। এই মায়ার টানেই আবার ফিরে আসে, আসতে হয়।
সে দিন আস্তে আস্তে রোলিং বেড়েই চলেছে, সাথে বাড়ছে বাতাসের একটানা শো শো গর্জন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক নাগারে এমনি চলছে। স্টিয়ারিং করতে এসে ব্রীজে কেউ টিকতে পারছে না। এক এক করে তিন জন আউট। টিকবে কি করে? ওরা কেও ব্রীজে দাঁড়াতেই পারছে না। প্রতিটা ঢেউ এসে যখন জাহাজের গায়ে আছড়ে পরছে তখনই সমস্ত জাহাজটা থরথর করে কেঁপে উঠছে। কতক্ষণ আর এ ভাবে চলা যায়? চার্টে দেখছি আমরা উপসাগরের পূর্ব পাড়ের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের জাহাজ থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে কিনারা। পিছনে দুবাই এবং ডান পাশে ওমানের সীমা রেখা। সামনেই লিটল কুইন এবং লার্জ কুইন নামে ওমানের সীমানার ভিতরে সাগরের মাঝে প্রায় মাইল দুয়েক জুড়ে মাত্র মাইল খানিক দূরত্বে দুটি পাহাড় সারি অনন্ত কাল ধরে দাঁড়িয়েই আছে। আবহাওয়া যখন ভাল থাকে তখন আমরা একটু মজা করার জন্য এই দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাতায়াত করি। তবে এই মাইল দুয়েক পথে খুব সাবধানে স্টিয়ারিং করতে হয় কারন পাহাড়ের চৌম্বক ক্ষেত্রের কারনে ওখান দিয়ে যাতায়াতে জাহাজের কম্পাস কিছুটা এলোমেলো হয়ে যায় বলে জাহাজের কোর্স ঠিক রাখা বেশ কঠিন কাজ। মোটামুটি খুব ভাল স্টিয়ারিং না করলে পাহাড়ের গায়ে যে কোন সময় ধাক্কা লেগে যেতে পারে। আর তেমন কিছু হলে এখান থেকে উদ্ধার পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু আজ এটা মোটেও সম্ভব নয়। কারো তেমন মানসিকতা নেই। সবাই রোলিং এর দাপটে অস্থির। বমি করতে করতে অসার। এই মধ্য সাগরে তো আর জাহাজ এমনি ছেড়ে দেয়া যায় না তাই যে কোন ভাবে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন আবহাওয়ায় ইঞ্জিন চালু রাখতেই হবে। ইচ্ছে করলেই পাড়ে এসে লগি গেড়ে বেঁধে রাখার উপায় নেই। সন্ধ্যার একটু আগে  আমাদের ক্যাপ্টেন ডেভিড ল্যাম্ব ব্রীজে এসে বলল কাসাব বে আর কত দূর? চার্ট দেখে হিসেব করে বললাম ওই ত লিটল কুইন তার পরেই কাসাব বে, তা এখান থেকে চল্লিশ নটিকাল মাইল হবে। যেতে হয়ত চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে। লিটল কুইন ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে ডান দিকে কাসাব বে হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে প্রায় চারদিকে ওমানের জন বসতি হীন মাইলের পর মাইল ধূ ধূ রুক্ষ পাথুরে পাহাড়ী এলাকা। শুধু সাগরের দিকে একটু খানি খোলা এবং ওই খোলা জায়গা দিয়ে ভিতরে ঢুকলেই প্রায় মাইল পাঁচেক এলাকা জুড়ে ত্রিশ মিটার গভীরতা নিয়ে একটা আশ্রয় নেওয়ার মত জায়গা। সামুদ্রিক চার্টে দেখান আছে। আমরা এর আগেও এখানে বেশ অনেকবার এসে নোঙ্গর করে থেকেছি। ক্যাপ্টেন চারদিকে দেখে বলল তাহলে ওখানে ঢুকে নোঙ্গর করে থাকি, দেখি আবহাওয়া একটু শান্ত হলে পরে যাওয়া যাবে। বললাম তাই ভাল হয়। সাথে সাথে আমাদের বাহরাইনের কোম্পানীর অফিসে কন্ট্রোল রুমের সাথে রেডিওতে যোগা যোগ করে জানিয়া দিলাম।

রাত প্রায় এগারটা নাগাদ আমরা কাসাব বের ভিতরে ঢুকে নোঙ্গর করলাম। এই এতক্ষণে যেন সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যারা রোলিং শুরু হবার পর থেকে এতক্ষণ না খেয়ে শুয়ে ছিল তারা উঠে সবাই গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) গিয়ে যে যা পাচ্ছে তাই খেয়ে একটু সুস্থ হলো। সে রাতে আর তেমন কিছু করায় কারো মন ছিল না। কেবল মাত্র ব্রিজ ওয়াচে দুই জন ডিউটি করছিল আর বাকী সবাই যার যার বিছানায়।
পর দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আবহাওয়ার তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মনে মনে কটু খুশি হলাম যাক আজও হয়ত এখানেই থাকা যাবে। এখানে থাকার একটা বাড়তি সুবিধা আছে। বড়শী দিয়ে প্রচুর মাছ ধরা যায়। আর জায়গাটাও চমৎকার। চারদিকে বেশ উঁচু নিচু নানা সাইজের পাহাড়। কোথাও খাড়া হয়ে সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে আবার কোথাও ঢালু  বালুকা বেলার মত মাঝে মাঝে কিছু কিছু ছোট বড় নানা আকারের পাথরের টুকরো দিয়ে কে যেন সাজিয়ে রেখেছে এমন মনে হতো। কোথাও কোথাও আবার  এমন যে আকাশের মেঘেরা উড়ে এসে প্রায়ই এই সব কোন পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয় নয়তো ধাক্কা দিয়ে সাথে করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। দেখতে দারুণ লাগে। এখানে এসে যখন থাকি তখন আমাদের জাহাজে  রাবারের একটা ইঞ্জিন চালিত ডিঙ্গি বোট আছে ওটায় পাম্প করে ফুলিয়ে প্রায়ই কয়েক জন মিলে জাহাজ ছেড়ে ওই সব কিনারায় চলে যেতাম। অহেতুক নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে উঠে দেখার চেষ্টা করতাম। এখান থেকে উত্তরে এবং পশ্চিমে সাগর বা পিছনের পাহাড়ী তেপান্তর কেমন দেখায়। মনে হতো যেন মৌন পাহাড় গুলি আমাদের সাথে কত দিনের না বলা সঞ্চিত কথা বলে মনের আকুতি মেটাতে চাইছে। আমরাও নানা দেশের কয়েক জন পাহাড়ের সাথে চীৎকার করে নিজ ভাষায় কথা বলতাম। আবার কখন সাথে করে রঙের টিন আর ব্রাশ নিয়ে পাথরের গায়ে নিজেদের নাম লিখে রাখতাম। আজও হয়ত যারা ওখানে যায় তারা আমাদের নাম দেখতে পায়। মাইক, হ্যারি, কার্লো, অসীম, মহসীন, তিরু, গোল্ডি এমন আরো অনেক যা আজ এত দিনে স্মৃতির পাতা থেকে মুছে গেছে।
সে দিন সকালে নাশতা করে বসে আছি এমন সময় ক্যাপ্টেন এসে বলল
“দেখছ এখন ওয়েদার চেঞ্জ হয়নি, আজ আর যাব না গ্রে বাহরাইনকে ডেকে বলে দাও তারপরে চল মাছ ধরি”।
ক্যাপটেন নিজে এ কথা বললে আর ঠেকায় কে? যেই বলা সেই কাজ। সাথে সাথে ব্রিজে যে ডিউটি করছিল ওকে সু সংবাদটা দিয়ে বলে এলাম তুমি গ্রে বাহরাইনকে কল দিয়ে বলে দাও খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমরা আজ এখান থেকে বের হতে পারছি না। সাথে সাথেই হ্যারি রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকা শুরু করল ‘গ্রে বাহরাইন গ্রে বাহরাইন দিস ইজ কুইন অফ গালফ কলিং’। ওপাশ থেকে জবাব এল
‘ইয়েস কুইন ইউ আর লাউড এন্ড ক্লিয়ার’।
হাই স্টেনলি গুড মর্নিং, ডিউ টু ব্যাড ওয়েদার উই আর নট সেইলিং ফ্রম কাসাব বে টু ডে।
ওকে কুইন
এবার ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ওভার এনড আউট বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল আর আমি নিচে নেমে এসে মার্কিকে বললাম
চল আজ একটা নতুন এক্সপেরিয়ান্স নেয়ার চেষ্টা করি।
নতুন আবার কি, এখানে যা করার তা সবইতো করা হয়ে গেছে!
না, আজ ডাইভিং করব। দেখছ না আজ পাহাড়ের কত কাছে নোঙ্গর করা হয়েছে। এত কাছে কি সাধারণতঃ নোঙ্গর করে?এই সুযোগ কি বারবার আসে?
ইয়া, ডাইভিং! বল কি?
হ্যা তুমি যাবে না কি অন্য কাওকে বলব?
এদিকে আমাদের জাহাজে ডাইভিং সেট আছে মাত্র দুটা কাজেই এক সাথে দুই জনের বেশি যেতে পারব না।
না না আমি যাব। কখন নামবে?
যদি যাও তাহলে এখনি।
বেশ, চল। ডিঙ্গি রেডি করে ডাইভিং সেট রেডি করতে করতে আরো কয়েক জনের নজরে এলো যে আমরা আজ এখানে ডাইভ দিচ্ছি।
সবার এক কথা আমাকে বললে না কেন?
আরে এইতো বললাম। আমরা ফিরে আসি তোমরা এক এক করে সবাই যেও। কাওকেতো উপরে থাকতেই হবে। তোমরা আমাদের দেখবে ফিরে এসে আমরা তোমাদের দেখব, তাই না?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
বেশ। আমি আর মার্কি ডাইভিং স্যুট পরে ক্রেন দিয়ে নিচে ডিঙ্গি নামিয়ে দিলাম।
এখানে পানির গভীরতা প্রায় ত্রিশ চল্লিশ মিটার হলে কি হবে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে একেবারে সমুদ্রের তলা পর্যন্ত দেখা যায়। স্বচ্ছ কাচের মত পরিস্কার টলটলে পানি। কত রকমের কত কি পানির তলে দেখা যায় তা কাছে থেকে দেখার লোভ ছিল অনেক দিন থেকেই। আজ তা হতে যাচ্ছে বলে মনে এক ধরনের চমক বোধ করছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে  ডিঙ্গিতে নেমে এলাম। দুই জনের কোমরে রশি বেঁধে রশির এক প্রান্ত ধরে উপরে পাহারায় থাকবে দুই জন। ওদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য প্রথা অনুযায়ী রশির টানের মানে নিয়ে একটু আলাপ করে নিয়েছি।

ডিঙ্গিতে নেমে পিঠের অক্সিজেনের টিউব, পায়ের ফিনস, হাতের গ্লোভস, ডাইভার্স নাইফ, পানি রোধক চশমা সব কিছু ঠিক আছে কি না দেখে ডিঙ্গির পাশে বসে পিছনে তাকিয়ে ইশারা দিয়ে ঝুপ করে নেমে গেলাম। নিচে সাগর তলে এগিয়ে যাচ্ছি। সাঁতরে সাঁতরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর নিচে নামছি। কত রকমের মাছ আশেপাশে দিয়ে আসছে যাচ্ছে। কেউ একটু কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে আসতে চাইছে। এরা আবার কারা এলো আমাদের এই স্বর্গ রাজ্যে? এমন একটা ভাব। একটু কাছে এসে ভাল করে দেখে সুরুত করে দিক বদলে চলে যাচ্ছে। নিচে নেমে এসেছি। এবার আর সাঁতার নয় হাঁটছি। পানিতে সাঁতরানো যত সহজ হাঁটা ততটাই কঠিন। হাঁটছি আর দেখছি। ফিনস পরা পায়ের নীচে পাথুরে তল বলে হাঁটা যাচ্ছে না লাফিয়ে সাঁতারের মত করে এগুচ্ছি।  ভয় ভয় লাগছে কিন্তু দুর্বার কৌতূহলের কাছে এই ভয় কিছুই নয়।

কত রকমের প্রবাল, মাছ, নানা রকম সামুদ্রিক উদ্ভিদ, বিভিন্ন প্রাণী এর কিছুই আগে দেখিনি। একটা ঝোপের মত মনে হচ্ছে প্রায় মানুষের সমান উঁচু। প্রবাল ঝোপ হবে নিশ্চয়! মার্কিকে খোঁচা দিয়ে ইশারা করলাম চিনেছ? ও তেমনি হাত নেড়ে নিষেধ করল। কি এটা? দেখতে হবে। কাছে গেলাম। নিচে থেকে ঝাঁক ঝাঁক ছোট ছোট সার্ডিন মাছ বের হয়ে গেল। আরো কত কি মাটি ঘেঁষে বসে ছিল তারা সবাই সুরুত সুরুত করে এদিক ওদিক চলে গেল। অবাক হয়ে দেখছি। কত রকমের রঙ্গিন মাছ। অদ্ভুত সব কারুকাজ তাদের গায়ে। লাল, কাল, ধবধবে সাদা, লাল কাল ডোরা কাটা, হলুদের মাঝে সাদা বা কালো ডোরা। কত যে রঙের বাহার তা আমাদের দেশের কাটাবনের একুরিয়ামের মাছের বাজারেও নেই। বিশাল ফিনস, গায়ের চেয়ে ফিনস বড়, বিশাল। কাকচি মাছের চেয়েও ছোট এক রকম মাছের ঝাঁক। সবাই মনের আনন্দে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এখানে হাঙ্গর বা ছোট ছোট মাছ খেয়ে ফেলে এমন কেউ নেই তাই এরা এত স্বাধীন। এক রকম ছোট্ট মাছ দেখলাম ঝাকে ঝাকে সাঁতরে বেড়াচ্ছে যাদের শরীরের এ পাশ থেকে ও পাশ ভেদ করে পানি দেখা যাচ্ছে, কোন রঙ নেই। গায়ের ভিতরে শুধু লাল কিছু রক্তের সরু অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। সাগর তলের বিছানায় কত রকমের স্টার ফিশ সহ আরো কত নাম না জানা প্রানী নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আমাদের সারা পেয়ে ঝট পট এদিক ওদিক নিরাপদ দুরত্বে চলে গেল। একটা  প্রবাল ধরে তুলে দেখলাম আমদের কক্সবাজারের দোকানে যেমন দেখা যায় তেমন নয় মোটেই। বিশ্রী শেওলা জড়ান। পানির হালকা স্রোতে শেওলা গুলি একটা ছন্দ তুলে দুলছে। নানা রকম নানা রঙের লতা পাতা স্রোতে দুলছে। এ যেন স্বর্গ রাজ্যের রূপনগর। পানির নিচে এত সুন্দর সে তো শুধু এত দিন টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি কিন্তু আজ নিজে চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চাইছে না। অথচ নিজের চোখকে কি করেইবা অবিশ্বাস করি? আস্তে আস্তে কিনারার দিকে অর্থাৎ পাহাড়ের নিচে যেতে চাইছি এমন সময়  মার্কির পায়ের ছোঁয়া লেগে ঝোপের বেশ খানিকটা ভেঙ্গে গেল। পিছনে ঘুড়ে উঠিয়ে হাতে নিলাম। আরে এত প্রবাল! প্রবালের এত বড় ঝোপ? সারি সারি অনেক। হাতে নিয়ে শেওলা সরিয়ে দেখি এগুলি সাদা নয় ভিন্ন রঙ, একটু লালচে ধরনের। দেখতে দেখতে নানা ঝোপঝার পার হয়ে একটু দূরে লক্ষ্য করলাম অন্ধকার মনে হচ্ছে। থমকে দাঁড়ালাম। মার্কি ইশারা করল। কি হয়েছে? ওকে ওই অন্ধকার দেখিয়ে বোঝালাম। ইশারায় বলল ওটা পাহাড়ের নিচের দিক।
তাই নাকি?

আরো একটু ভয় ভয় নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছি। দুই জনের কোমরে দুইটা আলাদা রশি বাধা। রশির আরেক মাথা ধরে জাহাজের ডেকে দুই জনে সজাগ রয়েছে কোন রকম একটু সিগন্যাল পেলেই টেনে জাহাজের দিকে নিয়ে যাবে। আবার এদিকে দুই জনের সাথে আলাদা যে রশি দুই জনকে বেধে রেখেছে যেন দুই জন একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়। স্রোত বা অন্য কোন উপায়ে  বিচ্ছিন্ন না হতে পারে। এগিয়ে যাচ্ছি আর এই রূপনগরের রূপ দেখে বিস্মিত হচ্ছি। মাটির পৃথিবী এবং সাগর তলের পৃথিবীর মধ্যে যে কত তফাত তা আজ এখানে না এলে কোন দিন জানা হত না। পানির নিচেও বাগান, বন জঙ্গল, নানা জাতের নানা ধরনের প্রাণী রয়েছে। অবশ্য সব প্রাণী যে নিরীহ বা হিংস্র নয় তা আমরা জানি। এখানেও ভয়ঙ্কর, হিংস্র বা বিষাক্ত বিভিন্ন প্রানীও বাস করে। এ নিয়ে তেমন আনন্দিত বা দু;খিত হবার কিছু নেই।

পাহাড়ের যতই কাছে যাচ্ছি ততই কেমন যেন গা ছম ছম করা একটা ভাব হচ্ছিল। ভয়ের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছিল, কিছুতেই সামাল দেয়া যাচ্ছিল না। বারবার হাতের ডাইভিং নাইফ এবং রশির অস্তিত্ব ঠিক আছে কিনা পরখ করছিলাম। কিছু হলেই যাতে জাহাজে সংকেত পাঠাতে পারি নিজেকে সেই ভাবেই রেডি রাখছিলাম। যদিও জানি হাতে যে ছুড়ি আছে ওটা দিয়ে হাঙ্গর বা তেমন কোন সামুদ্রিক হিংস্র মহাশয়কে কাবু করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয় তবুও হাতে রাখা। তবে মার্কি কি ভয় পাচ্ছিল না কি স্বাভাবিক ছিল তা আর জিজ্ঞাসা করিনি। আমি বুদ্ধি করে ওর পিছনেই থাকছি। এর মধ্যে জাহাজের তলা থেকে প্রায় দুইশত মিটার চলে এসেছি। আসার সময় জাহাজের নোঙ্গর দেখেছি। একটা শেওলা জড়ান বিশাল পাথরের ফাকে আট্‌কে আছে।
এগিয়ে যাচ্ছি আর এই নতুন দেখা রূপনগরের রূপের শোভা দেখছি। এক সময় পাহাড়ের নিচে এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণ আর কি দেখেছি? এখানে আরও সুন্দর। অসম্ভব রকমের সুন্দর। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি মাটির উপরে এমন কোন সাজানো বাগান নেই যা এখানকার চেয়ে সুন্দর। কিন্তু কথা হচ্ছে এই বাগানের মালী কোথায়? পানির উপর থেকে সূর্যের আলো এসে যেন সমস্ত বাগান আলোকিত করে রেখেছে। এখানেই এত সুন্দর তাহলে লিটল কুইন এবং লার্জ কুইনের নিচে বা বন্দর আব্বাসের পূর্ব দিকে সমুদ্রের পাড়ে যেখানে পাহাড় সাম্রাজ্য বিস্তার শেষ করে সাগরে মিশেছে সেখানে কেমন হবে? ভাবনার সাগরে ডুবে আবার কোথায় হারিয়ে গেলাম জানি না। হঠাৎ মার্কির সাথে ধাক্কা লেগে থেমে গেলাম। অক্সিজেনের মিটারের দিকে চেয়ে দেখি প্রেসার যথেষ্ট আছে। মার্কি দাঁড়িয়ে পরেছে। কি ব্যাপার? ও তখন সামনে একটু বাম দিকে দেখিয়ে দিল। দেখে আমার হৃৎপিণ্ড থেমে গেল শ্বাস নিতে ভুলে গেছি। বিশাল একটা কি যেন আশেপাশের সব কিছু নিতান্ত তাচ্ছিল্য ভরে মুখ হা করে এগিয়ে আসছে আর তার চার দিকে নানা আকৃতির নানা প্রজাতির মাছ ঘুর ঘুর করছে। কেউ কেউ আবার ওটার গায়ে জমা শেওলা ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে খাচ্ছে। ওটা হাঙ্গর নয় চিনতে পেরেছি কারণ হাঙ্গর হলে এই এত গুলি মাছ ওর কাছে থাকার সাহস পেত না। প্রাণীটা  যে  হিংস্র নয় তা তার চলা ফেরা এবং তার সঙ্গীদের দেখেই বুঝতে পারছি। মাঝে মাঝে ওটা নিজেও আসে পাশের গাছ পালা, লতাপাতা মুখে দিয়ে এবং পাথর আর প্রবাল থেকে একটু আধটু শেওলা চেখে দেখার ভাব করছিল। ওটার আকার প্রায় পাঁচ ছয় মিটার ব্যাসের একটা গোলাকার চাকতির মত, পিছনে প্রায় তিন মিটার লম্বা চিকন লেজ, সামনের অর্ধেকটাই প্রায় মুখ আর পিঠে উপরে ত্রিকোণাকৃতির আইর মাছের মত একটা প্রায় দুই মিটার উচ্চতার কাটা, মুখের দুই পাশে চার পাঁচটা কুলার আকারের ফিনস। সারা গায়ে সবুজ শেওলা জমে রয়েছে আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না। দেখে ভয়ংকর দর্শন মনে হলেও মোটেও হিংস্র মনে হচ্ছে না। তবুও অচেনা মহাজন বলে মন থেকে ভয় দূর করতে পারছি না। কি করব?মার্কি ইশারা করে বোঝাল এখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক, কোন নড়াচড়া করবে না। এমন বিকট এবং ভীষণ দর্শনের কোন প্রাণী দেখাতো দূরের কথা কোন দিন ছবিও দেখিনি। যাক, আমরা দুই জনেই চুপ করে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু মাত্র অক্সেজেনের বোতল থেকে শ্বাস নেয়ার পর বুদ বুদ বের হচ্ছে অথচ রূপনগরের মহাজন সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আস্তে আস্তে আমাদের কয়েক মিটার সামনে দিয়ে যেমন গতিতে আসছিল তেমনি  গজেন্দ্র গতিতে তার হেলাফেলা ভাব নিয়ে চলে গেল । সামনে দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করলাম উনার চোখ মাত্র একটা। মুখের সামনের দিকে একটু উপরে এবং গোলাকার পাতা সহ। মানে উনি চোখ বুজে ঘুমাতে পারেন।
আমাদের ছেড়ে কিছু দূর যাবার পরেই মার্কির হাতে চিমটি দিয়ে ইশারা করে হাতের ঘড়ি দেখালাম  আধা ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে। চল যথেষ্ট হয়েছে, আর না। রশিতে টান দিয়ে জাহাজে সংকেত পাঠিয়ে যে পথে এসেছিলাম সেই পথে যাবার জন্য উপরে ভেসে উঠলাম। আর আমাদের দেখা মাত্র জাহাজ থেকে যারা আমাদের পাহারায় ছিল ওরা রশি টেনে আমাদেরকে জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। ওই রূপ নগরের কথা আজও ভুলতে পারিনি। এখনও মনে হয় এইতো সেদিন দেখে এসেছি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Adventure

সাগর সেচা প্রাণ

গতকালের দেয়া সেইলিং অর্ডার অনুযায়ি আজ বিকেলে মাস্কাটে তেল আনলোড করে হিসেব নিকেশ বুঝিয়ে দিয়ে জাহাজে খাবার পানি এবং টুকিটাকি যা কিছু প্রয়োজন ছিল তা নেয়া হয়েছে। ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক ফুল লোডিং চলছে, বাকিটা চলতি পথেই দুই তিন ঘন্টার মধ্যে নেয়া হয়ে যাবে। সাগরের অবস্থা বেশ শান্ত। কোন অসুবিধা হবার সম্ভাবনা নেই। কাস্টম, ওমান ইমিগ্রেশন এবং মাস্কাট পোর্ট কন্ট্রোলের ছাড় পত্র নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে প্রায় সাড়ে ছয়টায় জাহাজ ইরানের আবাদান বন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়েছি। হারবার এলাকা থেকে বেড় হয়ে আরব্য উপসাগর দিয়ে ফুল এহেডে চলছে। একটু পরে নেভিগেশন লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। সামনে আশে পাশে দুই একটা জাহাজ আসছে যাচ্ছে তাদের নেভিগেশন বাতি দেখা যাচ্ছে। রাডারে দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ আবার আরো কিছু উত্তর দিয়ে আরব সাগরের দিকে যাচ্ছে।
ব্রীজের পিছন দিকে চার্ট টেবিলের পাশে ইলেকট্রিক কেটলিতে দুই কাপ কাল কফি বানিয়ে স্টিয়ারিং করছিল ডেভিড ওকে এক কাপ দিয়ে আমার চিরাচরিত অভ্যাস মত ব্রীজের বাইরে সাইড লাইটের উপরে বসে রাতের নীল সাগরের বুকে খোলা আকাশের নীচে দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলছি। এই অভ্যাস এক দিনের নয়। যত দিন থেকে নাবিক জীবন চলছে বলতে গেলে সেই থেকে এক ভাবে চলছে। এক কাপ কাল কফি না হলে যেন ব্রীজে ডিউটি করা যায় না!

রাত বারোটায় চীফ অফিসার লুইস এর ডিউটি। নিয়ম অনুযায়ী ঠিক পাঁচ মিনিট আগে লুইস ব্রীজে এলো। ওকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলাম ঘুমের ঘরে। এর পরে আবার সকাল আটটা থেকে ডিউটি। সকালের ডিউটিও নিয়ম মত দুপুর বারোটায় শেষ করে কেবিনে ফিরে এসেছি। গোসল করে দুপুরের লাঞ্চ করে একটু গড়িয়ে নেবার ইছে হলো। আরব দেশের জুন মাসের এই প্রচন্ড গরমে আমাদের দেশের আম কাঁঠাল পাকার গরমের কথা মনে এলো। কিন্তু মনে এলেই কি আর গাছের আম পেড়ে খাওয়া যায়? মনে মনে ভাবতে ভাবতে এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শুয়ে পরেছিলাম, কখন যেন একটু ঝিমানি ভাব এসেছিল। স্বপ্নে দেখছিলাম গ্রামের বাড়িতে আম বাগানের ছায়ায় বসে আছি আর ছোট ভাই বোনেরা আধাপাকা আম পেড়ে এনে দিচ্ছে। মুখে দিতে যাব এমন সময় কাছেই কার চিৎকারের শব্দ কানে এলো। চিৎকার শুনে চাচাত বোন নীলাকে কার কি হলো দেখতে বললাম। হাতের আম হাতেই ধরা রয়েছে এখনও মুখে দেইনি। সঙ্গে সঙ্গে নীলা চ্যাচিয়ে বলল দাদা পারুল গাছ থেকে পরে গেছে! কি? বলার সাথে সাথেই ঘুম ভেঙ্গে দেখি জাহাজের কেবিনে শুয়ে আছি। এটা নিজের গ্রামের বাড়ির আম বাগান নয় আরব্য উপসাগরের উপর দিয়ে আমার জাহাজ ইরানের আবাদান বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সেই কবে দেশ ছেড়ে এসেছি আবার কবেই যে যাব?মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু শুয়ে রইলাম। হঠাৎ করে কেন যেন মুখে কোথা থেকে এক রাশ থু থু জমে গেল। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না কিন্তু মুখে থু থু নিয়েই বা শুয়ে থাকি কি করে? তাই বাধ্য হয়েই উঠে পোর্ট হোল (জাহাজের কেবিনের এক রকম গোল জানালা) খুলে মাথাটা বের করে থু থু ফেলছি হঠাৎ জাহাজের পিছন দিকে চোখ যেতেই নীল সাগরের বুকে কি যেন কাল একটা ফুট বলের মত দেখলাম। একটু চমকে উঠলাম! কি ব্যাপার, এখানে এটা কি? গতকাল মাস্কাট বন্দর ছেড়ে আসার পর প্রায় দুই শত নটিক্যাল মাইল চলে এসেছি এখানে এই সাগরের মাঝে এটা কি?একটু অস্বাভাবিক মনে হলো। নিতান্ত কৌতুহল নিয়ে দেখার জন্য কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে জাহাজের পিছনে এসে দেখি কে একজন মানুষ। নিশ্চয় কেউ পরে গেছে! কে পরেছে?জাহাজ প্রায় বার নটিক্যাল মাইল বেগে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আশে পাশে দুই শত মাইলের মধ্যে কোন কূল কিনারা নেই।

জাহাজ থেকে মানুষ পরে গেলে যার নজরে আসে তাকে “ম্যান ওভার বোর্ড” বলে চিৎকার করতে হয়, এটাই নিয়ম। সেই অনুযায়ী চিৎকার করছি কিন্তু বুঝতে পারলাম আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। আতঙ্কে ভয়ে আমি দিশাহারা। কি করব? কি করব?দৌড়ে ব্রীজে চলে গেলাম। আমার ওই উদ্ভ্রান্তের মত চেহারা দেখে ব্রীজে যারা ছিল তারা জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে? কথা বলছ না কেন? আমি কিছুই বলতে পারছি না, আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। তবে কি করতে হবে তা ভুলিনি। তারাতারি ইঞ্জিন রুম টেলিগ্রাম টেনে জাহাজের গতি থামিয়ে দিলাম এবং উইলিয়াম স্টিয়ারিং করছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের হাতে স্টিয়ারিং নিয়ে জাহাজটা সম্পূর্ণ ডান দিকে ঘুড়িয়ে দিয়ে ওকে টেনে ব্রীজের বাইরে এনে হাতের ইশারায় পিছনে যে মাথাটা দেখেছিলাম সেটা দেখিয়ে দিলাম। পিছনে সেকেন্ড অফিসার ম্যাক্স এসে দাড়িয়েছে। ম্যাক্স জিজ্ঞেস করল “হু ইজ দ্যাট”? বললাম চিনতে পারিনি।

লোকটা এতক্ষণে বেশ পিছনে পরে গেছে। শান্ত সাগর বলে এখনও দেখা যাচ্ছে। একটু অশান্ত হলে আর দেখা যেত না। এবার উইলিয়াম এবং ম্যাক্সকে নিয়ে ব্রীজ থেকে নেমে মেইন ডেকে এলাম। এই খোলা সাগরে মাঝপথে হঠাৎ জাহাজ থেমে গেল কেন জানার জন্য প্রায় সবাই বাইরে চলে এসেছে। সবার মুখে প্রশ্নের ছায়া, কি হয়েছে? গত পরশু সকালে মাস্কাট আউটার এঙ্কারেজে ছিলাম তখন আমাদের রাবারের ডিঙ্গি বোট নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার জন্য পাশে নোঙ্গর করা ‘প্যাসিফিক ম্যারিনারে’ গিয়েছিলাম। ফিরে এসে সেই ডিঙ্গি ক্রেন দিয়ে তুলে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। তাতে পেট্রোল সহ সব কিছুই রেডি ছিল।
এর মধ্যে জাহাজ ঘুড়ে থেমে গেছে। ওরা সহ ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গিটা নামিয়ে আমি, ম্যাক্স আর উইলি এই তিন জন ডিঙ্গিতে নেমে এক টানে ডিঙ্গির ইঞ্জিন স্টার্ট করে ফুল স্পিডে এগিয়ে গেলাম। প্রায় সমুদ্র সমতলে নেমে এসেছি বলে আর ওই মাথা দেখা যাচ্ছে না। জাহাজের উপরে পিছন দিকের কোয়র্টার ডেকে যারা ছিল ওরা দেখিয়ে দিল ওই দিকে যাও।

এগিয়ে গেলাম। অল্প একটু পরেই ওই লোককে দেখা গেল। তারাতারি আরো তারাতারি যেতে হবে। দ্রুত গতিতে শ্বাস বইছে, বুক ঢিব ঢিব করছে, জিহবা শুকিয়ে গেছে। কেউ কোন কথা বলতে পারছে না, সবাই চিন্তিত। ডিঙ্গির হ্যান্ডেলের থ্রটল ঘুড়িয়ে স্পীড বাড়াতে চাচ্ছি কিন্তু এর চেয়ে বেশি স্পীড নেই। কাছে চলে এসেছি। এইতো আর একটু। আর একটু। হ্যা আরো কাছে চলে এসেছি প্রায় ধরা যায়। ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই এতক্ষণে চিনতে পারলাম। আমাদের জাহাজের টোপাস (ক্লিনার) ভারতের বিহার এলাকার অর্জুন।
যাক, সাঁতার জানত বলে এই এতক্ষণ ভেসে থাকতে পেরেছে। আমি হলে কি করতাম? আমি তো সাঁতার জানি না! এ কথা মনে হতেই আর এক দফা আতঙ্ক এসে ভর করল। তবুও কাঁপা কাঁপা হাতে ডিঙ্গির স্পীড কমিয়ে আস্তে আস্তে কাছে এসে ওকে ধরা মাত্রই হাত পা ছেড়ে দিয়ে একেবারে সেন্সলেস। সমস্ত শরীর নোনা পানিতে ঠান্ডা বরফের মত হয়ে গেছে। সবাই মিলে টেনে ডিঙ্গিতে উঠিয়ে শুইয়ে দিলাম। এবার ডিঙ্গি ঘুড়িয়ে জাহাজে ফিরে এসে অর্জুনকে ওই ডিঙ্গিতে রেখেই ডিঙ্গি সহ আমাদের সবাইকে ক্রেন দিয়ে তুলে নিল। জাহাজে উঠে দেখি ক্যাপ্টেন, চীফ ইঞ্জিনিয়ার, চীফ অফিসার সহ সবাই ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ক্যাপটেন বলল ওর কাপড় বদলে তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিয়ে তারাতারি চিকিত্সা রুমে নিয়ে গরম কম্বল গায়ে দিয়ে দাও আমি আসছি। একটু পরে ক্যাপ্টেন এসে হিটার চালাতে বলল। রুমটা গরম হবার পর অর্জুন একটু মিট মিট করে তাকাল। পাশে থাকা সবাই যেন হাতে চাঁদ পেলাম। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কোন কথা নেই। যেমন ছিল আবার তেমনি আসার দেহে পরে রইল। প্রায় আধা ঘন্টা পরে আবার মিট মিট করে তাকাল। বির বির করে প্রথম কথাটা বলল- ম্যায় মার গিয়া কিয়া (আমি কি মরে গেছি)? আরে না অর্জুন তুমি মরনি। এইতো আমরা সবাই তোমার পাশে। তুম লোগ কিয়া অবতার হ্যায়? না না, আমরা সবাই তোমার কলিগ। এবার নরে চরে উঠে বসল। ওকে উঠতে দেখে গ্যালি (কিচেন) থেকে ব্রান্ডি মেশানো গরম কাল কফি এনে দিলাম। তবুও ও বিশ্বাস করতে চাইছে না যে ও এখনো এই ধরনীর বুকে বেঁচে আছে। ক্যাপটেনের নির্দেশ মত আস্তে আস্তে ওকে বোঝাতে চাইলাম যে তুমি জাহাজ থেকে পরে যাবার পরই আমরা দেখতে পেয়ে সাথে সাথে ডিঙ্গি নিয়ে তোমাকে তুলে এনেছি, তুমি মরনি। সাগর সেচে আমরা তোমার প্রান ফিরে পেয়েছি। অর্জুন কাঁদবে না হাসবে না কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে সবার মুখের দিকে দেখছে। এবার ওর মুখে কফির কাপটা তুলে বললাম একটু একটু খেয়ে নাও।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Adventure