Category Archives: বাংলা সাহিত্য

প্রাক –চর্যার যুগের বাংলা ভাষা ও আধুনিক কবিতার সম্পর্কে কিছু কথাঃ

লক্ষনীয়ঃ 
BuZZ এ কেন জানি প্রায়ই এরর দেখাচ্ছে। তাই মেইল করে দিলাম। আমার বক্তব্য! পারলে আপনাদের কেউ পোস্ট করে দিন:
লেখক সুশান্ত কর
যান্ত্রিক গোলযোগের কারনে তিনি নিজ ব্লগে প্রচার করতে পারেননি বলে এখানে তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রচার করে দিলাম। স্মৃতিকণা।

চিনলেননা তো ! তবে কে আর দিদিমার মায়ের নাম মনে রাখে বলুন। আমি অপেক্ষা করছিলাম গোপীদা লিখবেন কিছু। তিনি সম্প্রতি ‘চর্যাপদ’ নিয়ে বই লিখেছেন কিনা।
যাই হোক এর থেকেই বাংলা এসেছে। ওটা প্রাক-চর্যাপদ যুগের প্রাকৃত ভাষা, সম্ভবত সৌরসেনী। হাজার বছরের চে’ও বেশি পুরোনো আমাদের প্রাক-বাংলা ভাষা। ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ নামের এক প্রাচীন সংকলনে এটি সংকলিত হয়েছিল।এর এক আধুনিক বাংলা অনুবাদ আমি করেছিলাম এরকমঃ
প্রিয়তম দূর দেশে
       দিগন্ত পার ।
ওড়না ওড়ালো এসে
       মেঘ বরষার ।।
মন দিয়ে পড়ুন আবার , দেখবেন এক ছোট্ট গল্প আছে এর মধ্যে। অনেক কথা বলেছেন কবি, অনেক কম বলে।
এর অনুকরণে আমি আরো লিখেছিলাম কিছুঃ
১)
কাশফুল ঝরে যায়;
      কপালের টিপ।
বাঁধা বেনী খুলে যায়
        নেভানো  প্রদীপ।
২)
‘বউ কথা কও’ পাখি
             ডাকিসনে আর
শিউলি ফোটেনা সখি
         ভাদো আশিনার
৩)
যে যদি মিনতি করে
           আঙটি ও হার;
দু’পা গেলে নদী বয়;
         কলসি দোয়ার।

 এবারে পড়ুন আমার বৈষ্ণব কবিতার যুগের ধাঁচে কবিতাঃ

তুই ছাড়া আর কার বা আমি
            নিলাম জাতি কুল;
কার প্রাণে বা বাজলো গিয়ে
          বাঁশি আমার ভুল!

ঝাড় উপাড়ি ডালে মূলে
           কে ভাসালে সুর;
তোর পায়ের নুপূর চেনে
         সাত সমুদ্দূর !

এখন সখি, সুখ হলো তোর-
        কী দিয়ে নিই প্রাণ!
ভুলেই গেছে যমুনা যে সেই
আগের কলতান!

দেখুন এবারে এখানে খালিদদার সেই প্রথম কবিতার সুর পাচ্ছেন কিনা।
—-
কিন্তু আমি আজকাল কবিতা লিখিনা। সত্যি বলতে ঐ যারা ইন্দিরাদিকে মধ্যযুগীয় বলে বিদ্রুপ করল কবিদের মধ্যে ওদের সংখ্যা এত্তো বেশি আর ওরা শক্তিতে এত্তো প্রবল যে আমার ঘেন্না ধরে গেল। আমি অবশ্যি হার মানবার পাত্র নই। কিন্তু আমার নিজেরই আগ্রহ গদ্যে বেড়ে গেল। কী আর করা।আমার সে দুঃখের কথা অরকুটের প্রফাইলে লেখা আছে।
এবারে ‘মধ্য যুগ’ শব্দটা আসলে ধার করা। আমাদের দেশে ইউরোপের মতো কোনো মধ্যযুগ কোনোদিন ছিল না। ইংরেজ গেছে , কিন্তু গোলামির মানসিকতা আমাদের যায়নি। তাই ওদের গোলামি করে ওদের থেকে ধার করা ধারণাতে জগত না দেখলে আমাদের অনেকে মধ্যযুগীয় বলে।

ইন্দিরাদি, আমি ঐ অরকুট গ্রুপে গিয়ে দেখেছি কে কি বলেছে। ওমন অসভ্যের মতো লিখত না যদি আপনি কবিতা নালিখে আমার মতো গদ্য লিখতেন। তখন বড়জোর আপনার সঙ্গে মতামত বিনিময় করত বা দ্বিমত পোষণ করত। এমন কাঁচা পণ্ডিতি কবিতা নিয়ে হয়। আমি ক’দিন আগে দেবেশ রায়ের একটা বই পড়েছি। ওখানে তিনি একজায়গাতে লিখেছেন, “কিছু দিন আগে কলকাতাতে এলেন কিউবার এক বিখ্যাত কবি। তিনি এক বৈঠকে, ‘আমার কাছে ত আমার কোনো কবিতার বই নেই, নইলে পড়ে শোনাতাম দু’চারটে কবিতা,’ বলতেই বেরিয়ে আসে বাঙালি শ্রোতাদের ভেতর থেকে তাঁর লেখা দু’দুটো কাব্যগ্রন্থ। সে কবিতো আমাদের আন্তর্জাতিকতায় হতবাক। দুনিয়ার এত খবর রাখতে গিয়ে নিজেদের খবর আমাদের বড় একটা রাখা হয় না,…।’

তিনি যেটি লেখেননি আমি লিখছি। মনে করুন, ওখানে অসমের বা ঊড়িষ্যার কোনো কবি গিয়ে ঐ কথা বলতেন। আমি নিশ্চিত ওখানে তাঁর একটাও কবিতা বেরুতো না। কারণ আধুনিক হবার দৌড়ে আমরা একটা ‘ঊড়ো খৈ গোবিন্দায় নমঃ’ তত্ব বের করেছি। যা কিছুতে পশ্চিমের গন্ধ আছে তাই আধুনিক। প্রাচ্যের সবকিছু পরিত্যাজ্য। উপেক্ষণীয়। আমরা কালিদাসের কথা বলি বটে কিন্তু কতজন বলুন জ্ঞানদাস, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, শাহ মুহম্মদ সগির, শৈয়দ আলাওলের কথা মনে রাখি। রাখিনা , কারণ ইংরেজি শিক্ষাতে জেনেছি ওরা আসার আগে যা কিছু ছিলো সব মধ্য যুগীয় এবং পরিত্যাজ্য।
‘দেইখ্যা আইলাম তারে সই , দেইখ্যা আইলাম তারে।
একই অঙ্গে এতো রূপ নয়ানে না ধরে…” (জ্ঞানদাস)
           এমন লাইনকে যে মধ্যযুগীয় বলে তার গালে চপেটাঘাত করা উচিত!

কিন্তু বলে। মাইকেলের আগের প্রায় সব্বার নাম আমাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে বা ঠাকুর ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ওটা ইংরেজ প্রীতিতে প্ল্যান করে করা হয়েছিল । এনিয়েও দেবেশ রায়ের ঐ বইতে কিছু দারুণ কথা আছে। কিন্তু তিনি উপন্যাস প্রসঙ্গে লিখেছেন। আমি টুকে দিচ্ছিঃ

“উনিশ শতকের দ্বীতিয়ার্ধে শুরুতে আমাদের ইংরেজ পুরাণ তৈরি হয়ে গেছে, তার পৌরাণিক স্বতঃসিদ্ধ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। তাই বঙ্কিম যখন উপন্যাস লেখেন তিনি সেই পুরাণকেই পৌরাণিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। সেখানে সমবেত উৎসবের মেজাজে পুরাণ কে ভাঙা হয় না, ব্যক্তি গত অভিনিবেশে সমবেত ইচ্ছার সেই পুরাণকে গড়ে তোলা হয়। তাতে মহৎ মহত্তর হয়, তুচ্ছ তুচ্ছতর হয়–উভয়ের অন্তর্বর্তী পার্থক্য আরো নির্দিষ্ট হয়। মঙ্গল কাব্যের আসরে, কীর্তনের আখরে, এমনকি খেউড়ের রাত জাগা বাসরে–কাহিনীর অন্য এক বিবরণ তৈরি হয়ে ছিল সেই পনের শতকের বরিশাল-চট্টগ্রামে-এর বঙালে, রংপুর-কোচবিহারের পৌণ্ড্রবর্ধনে, মেদিনীপুরের সমতটে, রাঢ়ে, ষোল শতকের শান্তিপুর-নদীয়ায়, আঠার-উনিশ শতকের নতুন কলকাতায়। কিন্তু আমাদের আধুনিকতা সেই সব বিবরণের মধ্য উপন্যাসের কোনো উপকরণ  খোজেনি। ফলে, ইংরেজি উপন্যাসের একটি বাঁধা ছক আমাদের উপন্যাসের বাঁধাছক তৈরি হয়ে উঠল এবং আজ পর্যন্ত তাইই এক মাত্র ছক। ইংরেজি উপন্যাসের কিন্তু কোনো বাঁধা ছক ছিল না– সেখানে উপন্যাস  হয়ে উঠেছিল প্রাক উপন্যাস কাহিনীর বিবরণ থেকেই, …।

আমাদের পক্ষে তো ইংরেজি উপন্যাসের সেই উৎসকে বাংলায় নিয়ে আসা সম্ভব ছিল না, পরিবর্তে ইংরেজি উপন্যাসের একটিমাত্র ছককেই মাত্র আনা গেল। কিন্তু তাতাই জানা হয়ে গেল–এটাই  উপন্যাস, একমাত্র উপন্যাস……’দুর্গেশ নন্দিনী প্রার আগেই আমরা ইংরেজি উপন্যাস থেকে জেনেছি উপন্যাস কী… আমাদের কাহিনী ভালো লাগার আধুনিকতা আমাদের কাহিনী বিবরণের ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ , একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।”
       
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হবার জন্যে দুঃখিত। আমি কফি হাউসে উদ্দীপনা গোস্বামীর এক কবিতা অনুবাদে রেখেছি। আমি কিছু মিশিং শব্দ লেখিকার মতোই রেখে দিয়েছি।দেখবেন ‘অভ্র’ লিখেছে শব্দগুলো ওর ভালো লাগেনি। এমনিতে অভ্র আমার অনুরাগী। কিন্তু সে ঐ কথা লিখেছে, কেননা ওভাবেই আমরা ভাবতে অভ্যস্থ।  যদি ওগুলো ইংরেজি হতো? বাব্বা! কোনো সংশয় কারো থাকতো না। ইন্দিরাদি,  আপনি একটু এমনি এমনি লিখে দিন আপনি স্পেনের রাম শ্যামের উত্তরাধুনিকতার দ্বারা  অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন, ব্যস আপনার ভক্ত সংখ্যা বেড়ে যাবে!ঃ)

2 টি মন্তব্য

Filed under বাংলা সাহিত্য

কোনো এক বোকা বুড়ির গল্প বলি শুনো

                                                              ।। সুশান্ত কর ।।
(বাংলা সাহিত্য থেকে অসমিয়া সাহিত্য লাভবান হয়েছে অনেক। এর জন্যে অসমিয়া সাহিত্য ও তার পরিমণ্ডল সম্পর্কে অনেক বাঙালি খবর রাখেন না, ভাবেন বুঝি এতেতো সবই বাংলারই বর্ণ-গন্ধ। কিন্তু তাতে যে কত অজানা বিষয় বাদ পড়ে যায়, নিজের রাজ্যটি সম্পর্কেও অজ্ঞতার পাহাড় জমা হয়— এই কথা ভাববার সময় হয়ে এলো। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলা সাহিত্য চর্চার জগতে আজকাল জোয়ার এসছে। অসমিয়া সাহিত্যের প্রতি বাড়িয়ে দেয়া বন্ধুত্বের হাত এই জোয়ারে জোর এনেছে। বরাক উপত্যকাতে বোধহয় সেটি সবে শুরু হচ্ছে। সম্প্রতি অসম সাহিত্য সভা এক নতুন চেহারা নিয়ে বরাক উপত্যকা ভ্রমণ করে এলো। এই গেল ০৮ জানুয়ারী থেকে ডিগবয়তে অনুষ্ঠিত  সারা অসম লেখিকা সংস্থার দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে এসছেন বরাক উপত্যকার দুই কবি বিজয় কুমার ভট্টাচার্য ও তুষার কান্তি নাথ। দীর্ঘদিন পরে শুধু ওদের দুজনের সঙ্গে আড্ডা দিতে ওখানে গেছিলাম ৮ তারিখের সন্ধ্যে বেলা। সম্মেলনের শেষে ১০ই সকালে যখন বিজয়দা ও তুষারদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন অভিজ্ঞতা? ওরা দুজনেই বললেন দারুণ। তাঁরা অভিভূত।  বিজয়দা তাঁর স্বভাবসুলভ ভংগীতে সেখানে শোনালেন উনিশ-একুশের কবিতা। এই কী বড় কম প্রাপ্তি? বিজয়দা ও তুষারদা নিশ্চয়ই শোনাবেন বরাক উপত্যকার পাঠকদের  তাঁদের ভ্রমণের কথা। আমার  তখনই মনে পড়ল অসমিয়া  লেখিকাদের অন্য একটি সংগঠন লেখিকা সমারোহ সমিতি ও তার প্রতিষ্ঠাতৃকে নিয়ে  আমার এক দীর্ঘদিন আগের অপ্রকাশিত লেখা রয়েছে। কেন না এই সুযোগে সেটি পড়াই (বরাকের) পাঠকদের?  লেখাটি চার বছর আগে লিখেছিলাম শিলচরের এক ছোট কাগজের জন্যে। কাগজটির সেই সংখ্যা বেরোয়নি। সামান্য সম্পাদনা করে ভাবলাম এটিকে এখনো প্রকাশ করা যায়।–লেখক )
(লেখাটি ছেপেছে শিলচরের দৈনিক জনকন্ঠ, তাদের ১৪ জানুয়ারী,১০ সংখ্যাতে তাঁরা এর শিরোনাম পালটে দিয়েছেলিখেছে, ” আসামের সাহিত্য চর্চা এবং এক নীরব সাহিত্য সাধিকার কথাঅসমের সাহিত্য চর্চা বললে কেবল অসমিয়া সাহিত্য বোঝায় না, না বরাকের বললে বোঝায় কেবল বাংলাসুতরাং এখানে সম্পাদক ভুল করেছেনদ্বিতীয়ত শীলা কেবল সাহিত্য সাধিকা ননএ লেখাতেও ঐ কথাগুলো রয়েছেএদিক থেকেও ভুলতার উপর নির্মলপ্রভা বরদলৈর এতো সুন্দর কবিতার  কিছু পংক্তি উঠিয়ে দেয়া হয়েছেসম্ভবত যিনি সম্পাদনা করেছেন তিনি নির্মল প্রভার উচ্চতা সম্পর্কে কোনো খবরই রাখেন নাসে রকম করতে গেলে যে মাঝে যে কিছু ডট বসাতে হয় সে নিয়মও মানা হয় নি লেখক ))
চর্যাপদের কবিরা কেউ কোনো রাজদরাবারের কবি ছিলেন , এমনটি জানা যায় নি। দুএকটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে কোনো এক নির্দিষ্ট ধর্ম সংস্কৃতির কেন্দ্র তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল, এমনটিও শোনা যায় নি। বাংলা-অসম দুই প্রদেশেই বৈষ্ণব-সূফী সাহিত্য চর্চারও এক গণ চরিত্র ছিল—আর তা কোথাও তেমন কেন্দ্রীভূত হতে পারে নি। রাজ দরবারগুলোও শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করত বটে। কিন্তু বাংলায় তা যেমন প্রাধান্য পেতে শুরু করেছিলশঙ্করোত্তর অসমে তার তেমন সুযোগও ঘটেনি, প্রয়োজনও পড়েনি। স্বয়ং শঙ্করদেব কোথাও বেশিদিন স্থির হয়ে বসেন নি, তার রচনাবলীও এক জায়গায় সংরক্ষিত ছিল না। বাংলাতে রাজদরবারের জায়গাটা প্রথমে কলকাতা ও পরে ঢাকা মহানগর নিলেও অসমে অবস্থাটা এখনো প্রায় একই আছে। অসমিয়া শিল্প সাহিত্য কোনো এক শহরকে কখনোই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় আসতে দেয় নি। এখনো দিতে প্রস্তুত নয়। বোধহয় দেওয়া সম্ভবও নয়। আধুনিক অসমে শিল্প সাহিত্য চর্চায় আপাত দৃষ্টিতে গুয়াহাটিকে কেন্দ্রীয় শহরের মতো দেখালেও আমাদের ভুললে চলবে না যে আধুনিক অসমিয়া সাহিত্য তার যাত্রা শুরু করেছিল শিবসাগর- যোরহাট থেকে। এখনো তার সে গৌরব ম্লান হয় নি, তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় হবার সুবাদে স্বাধীনতা উত্তরকালে ডিব্রুগড়ের নামও যুক্ত হয়েছে। রাজ্যের অন্যতম বড় প্রকাশনা সংস্থাটি এই শহরেই আছে। বনলতার একটি শাখা অনেক পরে গুয়াহাটিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। সঙ্গীত-অভিনয় কলাতে তেজপুর শতবর্ষ আগে যেমন, এখনো সমান গৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা শুধু কটি উদাহরণের নাম নিলামআসলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অজ পাড়াগাঁও এ রাজ্যে নেহাৎ ফেলনা নয়। পাঠশালার থেকে যাত্রা শুরু করে ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার আজতো সারা রাজ্যের বিস্ময়! আসলে বিস্ময় সে সারা দেশের। কিন্তু দেশ কি তার এ গৌরবের খবর রাখে? অসমের এই সাংস্কৃতিক চরিত্রের সুবিধেটা বাঙালি শিল্পী সাহিত্যিকের উপলব্ধি করা উচিৎ যারা কলকাতায় না গেলে , কলাকাতার লেবেল না লাগালে কল্কে পানও না, কাউকে সে কল্কে দেনও না।
বাংলার শিল্প সাহিত্যের সবই নগর কেন্দ্রীক বললে ভুল হবে, বস্তুত তা কলকাতা কেন্দ্রীক। অসমের প্রায় সবটাই অজপাড়াগাঁএ। অসমের নন্দন, রবীন্দ্র সদন, কলেজ ষ্ট্রীট, ময়দানের বইমেলা নেই বটেকিন্তু ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার, অন্বেষা গ্রন্থমেলা, সতীর্থ গ্রন্থমেলা, লেখিকা সমারোহ , লেখিকা সংস্থা আছে যার গণ চরিত্র সারাদেশে  অনন্য। আর এ নিয়ে সমাজতাত্বিক গবেষণা হয় নি যদি , হওয়া উচিত। বস্তুত অসম সাহিত্য সভা, বডো সাহিত্য সভা, মিসিং সাহিত্য সভা, মায় বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনও অসমের নিজস্ব প্রকৃতির দানভারতের অন্যত্র এর তুলনা মেলা ভার। সম্প্রতি গড়ে উঠা শঙ্করদেব কলাক্ষেত্র গুয়াহাটিতে গড়ে উঠলেও চু-কা-ফা কলা ক্ষেত্র গড়ে উঠছে যোরহাটে, লক্ষীমপুরের নারায়নপুরে গড়ে উঠছে মাধবদেব     কলাক্ষেত্র। আর এর প্রতিটিতে আছে ও থাকবে আম জনাতার সাদর আমন্ত্রণ। পাছে কোনো বনেদী বুদ্ধিজীবির বাঁকা চোখের ঘা আঘাত করে সে ভয়ে সাধারণ দর্শকের সেখানে পা কাঁপে না। যারা নন্দনে গেছেন আর শঙ্করদেব কলাক্ষেত্রে গেছেন তারা তফাৎ জানেন। সৌন্দর্যেও এই দ্বিতীয়টির কোনো তুলনাই হয় না।  বাংলায় গণসঙ্গীত বলুন, জীবন মুখী গান  বলুন নাইবা বাংলাব্যাণ্ড সবেতেই কলকাতার লেবেল সাঁটা না থাকলে কেউ জাতে তুলে না, পাতেও নেয় না। বোধকরি হেমাঙ্গ বিশ্বাসকেও শেষ জীবনে কলকাতার মোহে টেনেছিল। এইতো এখন আমাদের কালিকা প্রসাদকে সিলেটের গান শোনাবার জন্যে কলকাতাতে দৌড়ে গিয়ে ওখানকার তানে দোহার দিতে হয়েছে তবেই লোকে তাকে চিনেছে।   কিন্তু সেই হেমাঙ্গ বিশ্বাসকেও অসমের অজ পাড়াগাঁ যতটা সসম্মানে জীইয়ে রেখেছেকলকাতা তততাই দিয়েছে অবজ্ঞা আর উপেক্ষা। গাঁয়ের ছেলে কৃষ্ণমণি চুতিয়া যে চল গোরী, লে যাব তোকে মোর গাঁও বলে ডাক দিয়ে সব  গাঁয়ের গোরীদের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয় তা কোনো বঙ্গ সন্তানের পক্ষে করাটা একটু কঠিন বটে। কারণ তার চাই কলকাতার সার্টিফিকেট।
কম্যুনিষ্ট চিন থেকে পাওয়া একটা গল্প ভারতের বিপ্লবীদের মধ্যে একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল। সেই যে বোকা বুড়ার পাহাড় সরানোর গল্প। আজো কেউ কেউ উদ্ধৃতি দেন দেখি। ভালোই। কিন্তু এরকম কত হাজারো বোকা বুড়া যে পূর্বোত্তরের যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে তার খবর নিয়ে রাখলে কী কাজটা আরো ভালো হয় না?  এইতো সেদিন দেবজিৎ সাহা যা করে দেখালো  সে কাজটা কি বোকা বুড়োর চেঅন্যরকম কিছু ছিল? কিম্বা তার পরে যে সুরভী, সপ্তপর্ণা, অভিজ্ঞানেরা করে যাচ্ছে!  দেবজিতের সময়েই মণিপুরের ছোট্ট ছেলে পবন কুমার ( যার তথ্যচিত্র ২০০৬এর মুম্বাই চলচ্চিত্র উৎসবে দুদুটো পুরষ্কার ছিনিয়ে এখন বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে) কিম্বা অরুণাচলের লামা তাসি ( যাকে পূর্বোত্তরেই লোকে চিনেছে গ্র্যামী পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হবার পর) যা করে দেখাচ্ছেন সেও কি বোকা বুড়ার মতো এক অনন্য সাধন নয়? কলকাতাত প্রায় সবটাইত বৃটিশ ভারতের পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা’—মায় কলকাতা নিয়ে গৌরবের ব্যাপারটাও লণ্ডন ,পেরিস নিয়ে উপনিবেশিকদের গৌরবের নকলে গড়া। যেটি এমন কি পুরুলিয়ার সাহিত্যিক ব্যাপারকেও আঞ্চলিক; বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত ঐ সেদিন অব্দি, আর বরাক উপত্যকার বাংলা কা কথা! এরা জানে কদ্দূর এর কথা? অসমের  মতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এরকম আনায় আনায় আট আনা  করে দেখাক দেখি!
এমনি এক বোকা বুড়োর গল্প আজ বলব। তিনি অবশ্য বুড়ো নন, সত্তরোর্দ্ধ বুড়ি। তাঁর নাম শীলা  বরঠাকুর। এই ভদ্র মহিলাকে প্রচারের মোহ কখনোই টানে নি। তিনি যে কোনো বিদেশী গুরুর কাছে নারীবাদের পাঠ নিয়েছেন তাও শোনা যায় নি। তসলিমা নাসরিনের সাথে তাঁর কোনো তুলনাই করা যাবে না। করলে বরং তাঁকে অপমানই করা হবে। কারণ গত ত্রিশ বছরে  অসমের মাটিতে তিনি যে নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছেন তসলিমা এবং তাঁর স্তাবকেরা তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবেন না।
১৯৩৫ এর কোনো এক সময় যোরহাটের কাছে চারেঙিয়া বলে এক গাঁয়ে তাঁর জন্ম ।ছেলেবেলা কবছর বাবার সঙ্গে গিয়ে ঢাকাতেও কাটিয়েছেন। তাঁর আবাল্য ভালোবাসার বিষয়টি ছিল সঙ্গীত। মাত্র চার বছর বয়সে ১৯৩৯ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দিয়া আহুতি, লোয়া অর্ঘ আলহী মহান গানটি গেয়ে প্রশংসা কুড়োবার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। ১৯৪৯তে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে গুয়াহাটি বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত গায়িকা হবার যোগ্যতা অর্জন করে নেন। ১৯৫৬তে অসম সরকারের বৃত্তি পেয়ে বিশ্বভারতীতে সঙ্গীত শেখার সুযোগ পান। ১৯৬১ তে ভাতখণ্ডে সঙ্গীত বিদ্যাপীঠ থেকে সেতারে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে বাদ্য বিশারদ উপাধি লাভ করেন। এভাবে এগুতে থাকলে তাঁকে আমরা আজ অসমের এক অনন্যা সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে পেয়ে যেতেও পারতাম। কিন্তু যে পথ চেনা হয়ে গেছে, যে পথে আরো অনেক পথিকসে পথ ধরে হাঁটা বোধহয় তাঁর স্বভাবের বাইরে ছিল।
সত্তর দশকের শুরুর দিকে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাও যে  সে এক্কেবারে কংগ্রেসের রাজনীতিতে। দিনকতক দরং  জেলায় মহিলা  কংগ্রেসের আহ্বায়িকার দায়িত্বও পালন করেন। যে যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ততদিনে কেউকেটা হতেও পারতেন। কিন্তু পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনায় যার প্রাসাদ গড়া, তাঁর কিসের সুখ?
১৯৭২ সনে মহিলা শিল্পানুষ্ঠান নামে এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। রাজনীতির সাংগঠনিক দক্ষতাকে এভাবেই কাজে লাগিয়ে তাঁর মনে হলো দুস্থ মেয়েদের হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলবেন। ভালই চলছিল।  কয়েকশ মহিলা তাতে নানা সময়ে যোগ দিয়ে তাঁর স্বপ্নকে যতই সাকার করে তুলছিল তাঁর স্বপ্নের দিগন্ত ততই বিস্তৃত হচ্ছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল মেয়েদের বৌদ্ধিক জগৎটাকেই নাড়িয়ে দিতে হবে। মেয়েরা শুধু হাত খাটাবে আর মাথা খাটাবে সব ছেলের দলখাটাখাটুনির এই ভাগাভাগির ব্যাপারটাই তাঁর পোষাচ্ছিল না। তাঁর কাজের পথেও এ বিভাজন তাঁকে প্রচুর বাধার মুখে দাঁড় করাচ্ছিল।
ইচ্ছে করলেই তিনি মেয়েদের স্কুল খুলেই চুপচাপ চালিয়ে যেতে  পারতেন। অধ্যাপনাকে বৃত্তি হিসেবে নিয়েওছিলেন। তেজপুর গার্লস কলেজের প্রতিষ্ঠাতৃ অধ্যক্ষাও ছিলেন।  জ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ এতো প্রবল ছিল যে প্রায় ষাট বছর বয়সের কাছে এসেও, এই সেদিন ১৯৯৩তে পি এইচ ডি ডিগ্রীর জন্যে গবেষণাও করে ফেলেন। বয়সকে কাঁধে তুলে যারা নুয়ে পড়েন তিনি সে দলের কেউ নন। বয়সের কাঁধে চড়ে যারা দুনিয়া চষে বেড়ায় তিনি ঠিক সেই তাদের অগ্রপথিক। বিষয় ছিল, “Social Change in Assam: Since Independence with Special Reference to Sonitpur District.”  কিন্তু এহ বাহ্য! এ আর এমন কী? এতো খুবই জানা পথ, চেনা মুখ। সব শহরেই এমন মহিলার দেখা না মিলল, তবে আর একুশ শতকে এসে পৌঁছুবার আমাদের এতো গর্ব কিসের?
কিন্তু কেউ কি কখনো শুনেছে সেলাই স্কুলের মেয়েদের নিয়ে কেউ কখনো একটা সাহিত্য সংগঠন করার কথা ভেবেছে? এই না হলে আর বোকা বুড়ি বলে কাকে? এমনই এক বোকা বোকা প্রস্তাব ১৯৭৪ এর গোড়ার দিকে ঐ মহিলা শিল্পানুষ্ঠানের সাধারণ সভায় এগিয়ে ধরেন শীলা। যারা হাসবার তারা হেসেছে। হয়তো কেঁদেছেও কেউ কেউ। বয়স তখন  তাঁর চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। এ বয়সের এমন এক বিদূষী পাগল হলে কাঁদবার কথা বটে। কিন্তু ১৯৭৫ এ সদৌ অসম লেখিকা সমারোহ সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়েই গেল তেজপুরে। জ্যোতিপ্রসাদ, বিষ্ণু রাভা, ভুপেন হাজারিকা, ফনি শর্মার তেজপুরে। শীলা তার প্রতিষ্ঠাতৃ সভানেত্রী।
এখন তাহলে পাঠক জেনে গেছেন আমরা কোন পাহাড় সরানোর গল্প বলছি। হ্যাঁ, এখন ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় পার করে ঐ সংগঠনের শাখা কোথায় নেই? বরাক উপত্যকায় নেই। তার সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের দুপারে অজ পাড়াগাঁয়েও তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে। সে সংখ্যা আজ দুশরও বেশি হবে। ডিমাপুর, শিলঙের মতো পূর্বোত্তরের অন্য দুই শহরেতো বটেই কলকাতা, দিল্লী অব্দি এর সক্রিয় শাখা রয়েছে। প্রায় প্রতিটি শাখার রয়েছে নিজস্ব মুখপত্র এবং প্রকাশন। আর সবই করেন মেয়েরা। বরাকেও সম্প্রতি বাংলা ভাষী লেখিকাদের এমন দুএকটি প্রয়াস চোখে পড়ে বটে। এই যেমন নন্দিনী ছোট কাগজের মেলা বসিয়ে দিয়েছে। মেয়েদের এমন আদিখ্যেতার বহর দেখে বহু পুরুষ ভালোলেখকের নাক কোঁচকানোর কথাও আমরা জানি। শীলাকেও এমন অভিজ্ঞতার মধ্যি দিয়ে যেতে হয় নি বললে মিথ্যে বলা হবে।  কিন্তু তাতেই বা কি? আজ যে মামণি রয়সম গোস্বামী। নিরুপমা বরগোহাঁই, অরূপা পতঙ্গীয়া কলিতা , অনুরাধা শর্মা পূজারী, মণিকুন্তলা ভট্টাচার্যদের ভিড় অসমিয়া সাহিত্যে লেখিকা সমারোহ ছাড়া তার কতটা সম্ভব ছিল সন্দেহ আছে। এমন কোনো লেখিকা নেই আজ যিনি এ সংগঠনটির সঙ্গে সাথে কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে নেই। লেখিকা মাত্রের কাছেই সমারোহের সদস্যা হওয়াটা  ধর্ম স্বরূপ। সমারোহের সভা অনুষ্ঠান আদিই তাদের নামঘর।  আর হবে না কেন? স্বামী-শ্বশুরের সেবা যত্ন করে, শাশুড়ী ননদীর গঞ্জনা শুনে, ছেলেমেয়েদের পায়খানা পেচ্ছাব পরিচ্ছন্ন করে, অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন করে , রাঁধাবাড়া, কাপড়কাঁচা, ঝাড়ামোছা সাজগোজ করার পর যে মেয়েরা বলে, আর কোনো দিকে তাকাবার তাদের অবসর জোটে নাএখন সে কথাগুলোই তারা লেখে। শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে। গত তিন দশক জুড়ে এ এক রেকর্ড । কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের হাত না ধরেই- এ এক নীরব সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তার জন্যে কেউ নারীবাদের কাছেও দীক্ষা নেয় নিযদি পরে সে মতবাদে কেউ নাম লিখিয়েছে বা ঐ আন্দোলনকেও কেউ নারীবাদ বলে চালিয়ে দিয়েছে তবে সে অন্য কথা। কিন্তু এ সমারোহ অসম দেশের মাটির ফসল—“ এমন দেশটি কোথাও খোঁজে পাবে নাকো তুমি।
যারা রাজ ঘারানার লোক-তার মানে শিল্প সাহিত্যের নবরত্ন সংস্কৃতিতে  অভ্যস্থ তাদের এসব শুনে খুব হাসি পাবে। সে আমরা জানি। তারা হো! হো! করে হেসে বলবে,শিল্প সাহিত্য কি মুড়ি মুড়কি নি কিরে বাবা, যে হাজারে হাজারে লোকে করবে! তাদের প্রতি আমাদের জবাব হবে, না, জলসাঘরের অধিবাসীদের হাতের রজনীগন্ধা আর আঙুরদানার সঙ্গে এর এক আধটু তুলনা করা চলে বটে। কিন্তু সে ফুল ফলওতো ঝেড়েপোছে বাছাই করা। রাজার গা ঘেঁষা ছেড়ে একটু মাঠে ময়দানে ঘুরুন। চাষা ভূষোদের সাথে কথা বলুন। দেখবেন তারা শোনাবে সহস্র রজনীগন্ধার ঝরে যাবার গল্প—যারা রাজদরবার অব্দি পৌঁছুতেই পারেনি। কিন্তু যদি তাঁরা জন্মাতেই অস্বীকার করত তবে রাজার হাতে যা পৌঁছুতো সে কাঁঠালের আমসত্ব রজনীগন্ধা নয়।
সংগঠনটির বীজ বপন করেই শীলা হাত গুটিয়ে বসে পড়েন নি । সমারোহের নামটির মতো তাঁর নামটি এতো সুপরিচিত নয় বলে অনেকের এমন ধারণা হতেই পারে। ১৪ বছর তিনি এর প্রধান সম্পাদিকা ছিলেন, ১৩ বছর এর সভানেত্রী। সংস্থার মুখপত্র লেখিকার সম্পাদনা করেছেন ১৩টি বছর ধরে। আজ যেটি বিশাল বটবৃক্ষ তার শাখায় শাখায় ঢালা আছে শীলার আপন হাতের জল, পাতায় পাতায় তাঁর ভালোবাসার ছোঁয়া। তবে না সম্ভব হয়েছে এ বিপ্লব।
সংগঠনটি শুধু লেখিকা গড়ে তুলেছে বললে বলা হবে অতি অল্পই। সংগঠন গড়ার কলা আয়ত্ব করতে না পারলে সংগঠন কিসের? যখন এর কোনো সভায় পাঁচ মহিলা জোটে তখন তাঁরা কেবল রান্নার স্বাদ আর শাড়ির আঁচল নিয়ে কথা বলে না। বরং অচিরেই সে কথা রান্না করবার বিস্বাদ আর শাড়ির আঁচল তানার বিবাদের ইতিকথাতে গিয়ে প্রবেশ করে। পরিবার নামের রাষ্ট্রটির ভেতরকার যে রাজনীতি তার কথা পুরষেরা লেখে কৈতারা যে বড় রাজনীতি বোঝে না বলে মেয়েদের ব্যঙ্গ করে? এমন সংগঠনে দক্ষ, রাজনীতিতে সচেতন, শিল্প কলায় বিদূষী মেয়েদের সন্তানেরা তাহলে করছে টা কী? হচ্ছেটা কী? খবর করুন। কল্পনা করুন! স্বপ্ন দেখুন…।
চিন দেশের সেই বোকা বূড়ার গল্পে আছে, আকাশের দেবতা শেষে খুশী হয়ে দুই দেবদূত পাঠিয়েছিলেন। তারা এসে সে পাহাড় তুলে নিয়ে গেছিল বুড়ো মারা যাবার আগেই। বুড়ো তখনো তখনো পাহাড় খুঁড়ে চলেছেআরব্ধ কাজ থেকে ছুটি নেয় নি। ২০০৬এর জানুয়ারি মাসে  রঙিয়া শহরে ঠিক ত্রিশ বছর বয়সে সমারোহের যে দ্বিবার্ষিক অধিবেশন হয়ে গেল সেখানেও দেবদূতীরা পাহাড় তুলে নিয়ে গেল। বয়স হয়েছে। শরীর বিদ্রোহ করেছে। শীলা তাই সেবারে সক্রিয় দায়িত্ব থকে বিদেয় নিলেন। এখন তিনি বিশ্রামের শিল্প গড়ে চলেছেন। সমারোহকে চালিয়ে নেবার জন্যে এখন রয়েছে অজস্র লোক। সে নিয়ে তাঁর না ভাবলেও চলে। ভারত সরকার তাঁর সারা জীবনের কাজের সম্মানে ২০০৮এ পদ্মশ্রী দিয়ে সম্মানিত করেছে।
প্রয়াত নির্মল প্রভা বরদলৈ  অসমের এই অনন্যা কন্যাটিকে নিয়ে এক আশ্চর্য সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন , শীলা নামটির অর্থ এর চে; আর অন্যভাবে লেখাই যেত নাঃ
                 শীলা কি এটা ফুলর পাহি?
শীলা কি এটা সুর?
শীলা কি এধানি সেউজীয়া?
শীলা কি জোনাক জুর?
শীলা যে এক সুষমা
     বর্ণ গন্ধর সমাহার।
শীলা যেন এক ছন্দ
মৌন নারীর, নীরব নারীর কণ্ঠর এক মঞ্চ।
শীলা দূরদর্শী এক জাগরণ
গতিহীনতার বুকুত
শীলা যেন বাংময়তা
জাগ্রত, সচেতন।
শীলা পংকজা এক শক্তি
সময়র দৃঢ় আহ্বান
স্থির , প্রজ্জ্বলিত এক শিখা
জাগ্রত এক উত্থান।
শীলা রূপান্তরর শিল্পী
জোনাকী বাটেদি আইদেউক নিয়াব
দেখুয়ালে নিজ পথটি?
মোর অভিনন্দন শীলালৈ
শীলালৈ অভিনন্দন
এনেকুয়া লাগে
শীলা যেন
মোর বুকুরেই স্পন্দন।
এ কি কেবল নির্মল প্রভারই বুকের কথা? এনেকুয়া লাগে, শীলা যেন/ মোর বুকুরেই স্পন্দন। প্রতিজন সমারোহ সদস্যাকে জিজ্ঞেস করুন তিনি বলবেন, এনেকুয়া লাগে, শীলা যেন/ মোর বুকুরেই স্পন্দন। দিন আসছে, অসমের প্রতিজন মানুষ বলবে, এনেকুয়া লাগে, শীলা যেন/ মোর বুকুরেই স্পন্দন। বরাক উপত্যকার বাঙালি সমাজও কী বলবে? বলুন না, মন্দ কী? এওতো অসমকলকাতার বাতাসে শ্বাস নেবার বৃথা প্রয়াসতো অনেক হলো। এবারে একটু ঘুরে দাঁড়ানো যাক না। চেনা যাক না, অসমের মাটি ও মানুষকে? বরাকেও তো দুএকজন শীলা বরঠাকুর আছেন। ওখানকার মাটিও চাইছে এমনই এক কাঊকে। চাইবেই। একই আকাশ, একই বাতাস যে এর ! শুধু বিমানে চড়ে এসে কলকাতার শব্দ দূষণ শুনতে দিচ্ছে না সে আহ্বান। এবারে যে ছোট কাগজের মেলাটি হচ্ছে সে মেলা একটু হলেও যদি এ দূষণ মুক্তি ঘটায়, গাঁয়ে গঞ্জের নির্মল বাতাস টেনে আনে তবেই  আমাদেরও আশা করবার থাকবে  অনেক কিছু।
মূল লেখাঃ ৩ থেকে ৫ মার্চ , ২০০৬ । সম্পাদনাঃ ১০-০১-১০
টিকাঃ
১) উনিশ একুশঃ ১৯৬১র ১৯শে মে তারিখে বাংলাকে রাজ্য ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে ১১ জন বাঙালি শহিদ হয়েছিলেন শিলচর রেল ষ্টেশনে। তার পর ১৯৭২এর ১৭ আগষ্ট ,  এবং ১৯৮৬র ২১ জুলাই করিমগঞ্জে আরো ৩ জন। বিজয় ভট্টাচার্য সারা জীবনে ঐ ভাষা শহিদ্দের নিয়ে অজস্র কবিতা লেখার জন্যে  খ্যাত। একুশ বললে বাংলাদেশের একুশও বোঝায় বটে, সে নিয়েও এখানে আবেগ কম নেই।
২) নন্দিনীঃ নন্দিনী সাহিত্য পাঠক চক্র অসমের বরাক উপত্যকার লেখিকাদের এক সংগঠনমূলত শিলচর শহর ভিত্তিক এই সংগঠন গেল ৮ ও ৯ জানুয়ারি, ২০১০ তারিখে শিলচরে এক বৃহৎ আয়োজনে ছোট কাগজের মেলা করেএদের সংগঠনের মূল ভিত্তিটি রয়েছে বাংলাদেশেএও এক মজার খবর

              উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে শীলাকে এক অনুষ্ঠানে অসমের পরম্পরাগত সরাই দিয়ে সম্বর্ধনা জানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী তরুণ গগৈ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under অসম, অসমিয়া সাহিত্য, কলকাতা, পূর্বোত্তর ভারত, বাংলা সাহিত্য