Monthly Archives: অগাষ্ট 2012

আভিজাত্য

১।
সোলায়মান হায়দর। বাড়ি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে প্রায় ৪০ মাইল উত্তরে কালাকান নামের ছোট্ট শহর ছেড়ে আরও প্রায় ১৫ মাইল উত্তরে সাওয়ারখিল ছেড়ে এশিয়ান হাইওয়ে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে কারাকান বাজারে ডান দিকে মোর নিয়ে যে ইসতালিফ সড়ক পূর্ব দিকে চলে গেছে তার বাম পাশে চৌরাস্তার ধারে। নিচে বিশাল মটর পার্টস এর দোকান আর দোতলায় বসত বাড়ি। মটর
পার্টসের দোকান হলে কি হবে সাথে কিছু বন্দুক আর পিস্তলের গোলাগুলি সহ টুকি টাকিও আছে। রাশিয়ানরা যখন এখানে যুদ্ধ করছিল তখন নিতান্ত জীবন রক্ষার তাগিদে এলাকা বাসিদের অনুরোধে এগুলি রাখতে হত।
বাবা আফছার হায়দর স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং অনেক ভু-সম্পত্তির মালিক। ভু-সম্পত্তি বলতে বিশাল পাথুরে পাহাড়ি এলাকা যেখানে কোন ফসল বা চাষাবাদ হয় না শুধু ছাগল আর দুম্বার চারণ ভূমি। ছাগল জাতীয় পশুর খাদ্য সাদা কষ হয় এমন পাহাড়ি ঘাসে ভরা। হাজার খানিক ছাগল আছে ওদের। তবে এই সব পাহাড়ি এলাকার বৃষ্টির পানি বয়ে যাবার জন্য যে নালা এশিয়ান হাইওয়ে পাড় হয়ে কাবুল শহরের পশ্চিম দিয়ে বয়ে গেছে সেখানে এই নালার পাড়ে কিছু জমি আছে ওখানে শুধু পায়রা আর ভুট্টার চাষ হয়, পাশে ছোট্ট একটুকরা আঙ্গুর বাগান আছে। মোটামুটি উচ্চ বিত্ত পরিবার। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে এই অনেক। সোলায়মান কাবুলে লেখাপড়া শেষ করে বাবার সাথে দোকানের কাজে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে কান্দাহার এবং পাকিস্তানের বর্ডার থেকে এটা সেটা যা পায় নিয়ে আসে। আবার ওদিকে ইরানের বর্ডারেও যাতায়াত আছে। বন্ধুরা মিলে গাধার গাড়িতে তাঁবু সহ প্রয়োজনীয় মালামাল বহন আর ঘোড়া নিয়ে যাতায়াতে আড্ডার আড্ডাও হয় আবার এক ঢিলে বাবাকেও কিছু সাহায্য করা হয়ে যায়। কিছু মালামাল নিয়ে আসা যায়।
রাশিয়ানরা যুদ্ধ করছে করুক, ওরা প্রায়ই ওদের দোকানের সামনে দিয়েই সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে ধুলো উড়িয়ে কাবুল যায় আবার লরি ভরে বাজার সদাই নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জনপদের বাইরে ওদের আস্তানায় চলে যায়। সামনে পরে গেলে ইশারায় কুশল বিনিময় হয় কখনো। সব কিছুই চলছিল বেশ। বাদ সাধল যখন আমেরিকানরা এলো। এমনিতেই আফগানরা জাতি হিসেবে একটু, না না একটু নয় বেশ স্বাধীনচেতা। কারো বশ্যতা মেনে নেয়া ওদের ধাতে নেই।
আমেরিকানরা এসেছে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আফগানিস্তানের দখল নিয়ে আমেরিকান সাম্রাজ্য বিস্তারের আশা নিয়ে। তা বেশ মারামারি কাটাকাটি খুনখারাবি করবি কর। আমরা কি কম পারি এগুলি? আমরা জাতি হিসেবে যোদ্ধার জাতি সে কথা কি তোরা ভুলে গেলি! বাগড়ম এয়ার ফিল্ড দখলের উছিলায় যেদিন গোলাগুলি শুরু হল সেই সময় গোলাগুলির এক পর্যায়ে একদিন এলাকার প্রায় সবাই বাড়ি ঘর দোকান পাট ছেড়ে গাধার গাড়িতে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমি এবং জনবসতির শেষ সীমা জুলফিকার খাইলে মামা বাড়িতে চলে যায়। দিন পনের পরে যখন গোলাগুলি বন্ধ হল তখন একদিন সোলায়মানের বাবা গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে এসে নিজ এলাকা দেখে গেল। বাবা যখন ফিরে এলো তখন তার কাছে শুনল তাদের বাড়ি ঘর দোকান কোন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শুধু তাদের না কারাকান বাজারের কোন চিহ্ন বলতে লাইট পোস্টের কয়েকটা খুঁটি ছাড়া আর কিছু নেই। সব ভেঙ্গে চুরে ধ্বংসস্তুপ হয়ে আছে। এই সব শুনে বাবার সাথে তার পরদিন বাপ বেটা দুইজনে দুইটা গাধা নিয়ে দেখতে এলো। বাবা নিষেধ করেছিল আর যেয়ে কি হবে, কি দেখবি? কিছুই যে আর নেই! না বাবা আমি দেখব, আমাকে যে এর প্রতিশোধ নিতে হবে। মাও নিষেধ করল কিন্তু সোলায়মান নাছোড় বান্দা, সে নিজ চোখে দেখবেই।
আরে বেকুব তুই কি করে আমেরিকানদের সাথে পাল্লা দিতে যাবি? না মা আমি দেখবই, তুমি বাবাকে যেতে দিতে না চাইলে দিও না আমি একাই যাব। ছেলের মনের দুঃখ বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত বাবা তার সাথে এলেন। হাইওয়ের পশ্চিম পাশে এসে গাধার পিঠে থেকে নেমে দুই জনে দাঁড়িয়ে দেখল কিছুই নেই।
মামারাও বেশ উচ্চ বিত্তের মানুষ কিন্তু হলে কি হবে এ ভাবে কত দিন চলা যায়? বাবা আর মামার সাথে পরামর্শ করে কাগজপত্র গুছিয়ে কাবুলে এসে ব্রিটেনের দূতাবাসে ভিসার দরখাস্ত জমা দিয়ে এলো। দূতাবাস থেকে একটা তারিখ বলে দিল, পাসপোর্ট নেয়ার জন্য। সময় মত এসে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দেখল ভিসা হয়েছে। বাড়িঘর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বলে একেবারে তিন বছরের ভিসা।
শুরু হল লন্ডন আসার প্রস্তুতি। বেশী দেরি করা যাবে না, যত তারা তারি সম্ভব দেশ ছেড়ে আসতে হবে। আমেরিকানদের মতিগতি বলা যায় না। একদিন সত্যি সত্যি মায়ের কান্না বাবার নিষেধ উপেক্ষা করে নিজের নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র নিয়ে চলে এলো লন্ডনে। কাবুলে যাদের সাথে লেখাপড়া করেছে তেমন এক বন্ধু কাদের হেকমত বেশ অনেকদিন আগেই লন্ডনে এসেছিল। আরও কয়েকজন মিলে স্টেপনি গ্রিনের কাছে গ্লোব রোডে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। সোলায়মানের টেলিগ্রাম পেয়ে সময়মত হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। পথে টিউবে পাশাপাশি বসে এত দিন পরে দেখা হওয়া দুই বন্ধুর অনেক কথা। তার মধ্যে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ঘোলাটে ও অস্থির পরিস্থিতিই প্রধান। কাদের বেথনেল গ্রিনে টেসকো সুপারস্টোরের পাশে এক কাশ্মিরী দোকানের সামনের ফুটপাথে জুতা স্যান্ডেল বিক্রি করে। সেও আফগানি এক সম্ভ্রান্ত উচ্চ বিত্ত পরিবারের ছেলে কিন্তু পৃথিবীর দুই শক্তির উন্মত্ততার খেলায় তাদের ভাগ্যের বিড়ম্বনার জন্য আজ এই অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
কয়েকদিন যাবার পর সোলায়মান বলল দোস্ত,
আমার কি ব্যবস্থা করতে পারবে?
এসেছ যখন কিছু করতেই হবে, এ নিয়ে তোমার ভাবনার কিছু নেই, তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে, আমাকে সাহায্য করবে। আমি বড্ড নিঃসঙ্গ বলে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তুমি কয়েক দিন এদিক ওদিক ঘুরে দেখে শুনে চিনে নাও তারপরে আমার সাথে দোকানে থাকবে। তোমাকে দোকানে রেখে আমি মাল আনতে গেলাম বা কখনও তুমি মাল নিয়ে আসলে আর আমি দোকানে রইলাম। কি, পারবে না?
কি বল দোস্ত পারব না কেন এযে সোনায় সোহাগা! আমি ভাবতেই পারছি না! আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তায়ালা তোমার মঙ্গল করুন।
হিসাব নিকাশের জন্য তুমি কিচ্ছু ভাববে না, লাভ লোকসান সব আধাআধি! ঠিক আছে?
আমার যে কোন চালান নেই? আমি কি করে তোমার সাথে ব্যবসা শেয়ার করব?
কে বলল চালান নেই, তোমার এই মাথার মগজগুলিকে তোমার চালানে বদলে নিলেই দেখবে তোমার কত চালান!
বলে একটু হেসে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল তুমি এসেছ বলে আমি যে কত খুশী হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না।
কাদের তুমি মহান! ঠিক আছে আমি তোমার সিদ্ধান্ত জেনে অতি আনন্দিত। তাহলে বাড়িতে বাবাকে একটা চিঠি দিতে হয়।
তা জানিয়ে দাও, আর চিঠিতে বলে দিও আমার বাড়িতে যেন একটু সংবাদ দেয়।
হ্যাঁ হ্যাঁ তা অবশ্যই বলব।
২।
কাদের আর সোলায়মান দুই বন্ধু মিলে বেশ চালিয়ে যাচ্ছিল। দুই জনে মিলে কাস্টমার ডাকাডাকি করে বিক্রি করে, মাল কিনে আনে আবার সারা দিনের শেষে সন্ধ্যা হলে মালামাল গুছিয়ে কার্টুনে ভরে কাশ্মীরী দোকানের পিছনে এক কোণে রেখে চলে যায়। যাবার সময় প্রায়ই পাশের টেসকো সুপারস্টোর থেকে রেডি নান এবং আর একটু এগিয়ে পাকিস্তানি কাবাবিশ দোকান থেকে গ্রিল চিকেন কিংবা শিক কাবাব বা ভিন্ন কিছু কিনে দুই বন্ধু পাশাপাশি হাটতে হাটতে ভবিষ্যতের কল্পনার জাল বুনতে বুনতে গ্লোব রোডের বাসায় এসে খেয়ে শুয়ে পরে আর সারা দিনের কঠিন যুদ্ধের পর ক্লান্ত শরীর প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পরে পরের দিনের প্রস্তুতি নিতে।
দুই বন্ধু মিলে বেশ চলে যাচ্ছিল।
ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যায় বৃষ্টির জন্য রাস্তায় কোন লোকজন ছিল না কাস্টমার আসার কোন সম্ভাবনা নেই মনে করে কাদের দোকান গুটিয়ে নিচ্ছিল আর সোলায়মানকে বলল তুমি টেসকো থেকে রুটি নিয়ে আস আমি দোকান প্যাক করছি। সোলায়মান বন্ধুর কথামত টেসকোতে যেয়ে নান রুটি, দুধ, দৈ এবং সকালের নাস্তার জন্য এক প্যাকেট কর্ণ ফ্ল্যাক্স নিয়ে কাউন্টারের পাশে এসে হাতের ঝুরিটা নামিয়ে দেখল অপরূপা কাল কেশী এক সুন্দরী মেয়ে ওই কাউন্টারে কাজ করছে। পরনে টেসকোর নির্দিষ্ট পোশাক বলে বুঝতে পারল না এ কোন দেশী। তবে সার্টের পকেটে লেখা নাম দেখল ফাতেমা। যাক তাহলে এ মুসলমান। এর আগেও এসেছে কিন্তু কোনদিন দেখেনি, হয়ত ডিউটি ছিলনা কিংবা ভিন্ন কোন টিলে ছিল বলে দেখেনি। যথারীতি কিউ এগিয়ে যাচ্ছে আর যখন সোলায়মানের পালা এলো তখন সে এক এক করে পাশের ঝুরি থেকে তার জিনিসপত্র কনভেয়ার বেল্টে নামাচ্ছে আর মেয়েটির দিকে দেখছে। লক্ষ করল মেয়েটিও তাকে লক্ষ করছে। এক্সকিউজ মি, আমি কি জানতে পারি তুমি (ইংরেজি ভাষায় আপনির প্রচলন নেই তাই তুমি) কোন দেশের?
কেন?
নিতান্ত কৌতূহল।
একটু হেসে দিয়ে বলল-
তুমি কোন দেশের?
আমি আফগানিস্তান থেকে এসেছি, তুমি?
আমার মা বাবা এবং পূর্ব পুরুষ পাকিস্তানের তবে আমি এই দেশের।
ও আচ্ছা।
কথার ফাঁকে ফাঁকে ফাতেমা সোলায়মানের জিনিসপত্র স্ক্যান করছে আর ব্যাগে ভরছে।
সব কিছু স্ক্যান হলে দেখা গেল ওর ১২ পাউন্ড ৭২ পেনি দাম হয়েছে।
২০ পাউন্ডের একটা নোট বেল্টের উপর নামিয়ে রাখল আর যথারীতি ফাতেমা টিল থেকে ভাংতি ফেরত দিল।
সোলায়মান ভাংতি নেয়ার সময় আবার দুজনের চোখে চোখ পড়ে গেল, একটু মিষ্টি হাসির সাথে ফাতেমা সোলায়মানের হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিল।
গুড নাইট, আবার দেখা হবে বলে সেদিনের মত সোলায়মান চলে এলো আর ফাতেমা পরের কাস্টমারকে এটেন্ড করতে মনোযোগ দিল।
এই ভাবে বেশ কয়েকদিন গেল। দোকান বন্ধ করার আগে সোলায়মান বলে দোস্ত তুই মালামাল গুছিয়ে নে আমি টেসকো থেকে আসছি। কোন দিন চা পাতা, কোন দিন চিনি কিছু না কিছু তো একটা কিছু লাগেই হোক না সে দুইজনের সংসার। এমনি একদিন সোলায়মান ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করে বসল-
আজ তোমার ডিউটি কয়টা পর্যন্ত?
এইতো আর মাত্র আধা ঘণ্টা আছে, ৮টায় শেষ হবে, কেন?
না, তেমন কিছু না। তোমার সাথে একটু আলাপ করতাম, এই আর কি!
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি কি আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবে?
আধা ঘণ্টা কেন, তুমি যদি বল এক বছরও পারব।
তুমি খুব দ্রুত এগিয়ে গেছ মনে হচ্ছে! আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ওই ডান পাশের এক্সিট এর বাইরে দাঁড়াও আমি শেষ করে আসছি।
৩।
ফাতেমার দাদার বাড়ি পাকিস্তানের ফয়সালাবাদের (প্রাক্তন লায়ালপুর) খুরিয়ান ওয়ালায়। দাদা ওমর বখত পাকিস্তান ভারত স্বাধীনের পর এদেশে চলে আসে। এখানেই বিয়ে করে সংসার ব্যবসা করে বেশ অর্থ, নাম, যশ ও প্রতিপত্তি কিনে নেয় মানে সে তার ভাগ্যের কাছে থেকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিল। এখানেই জন্ম হয় একমাত্র ছেলে আবুল বখ্তের। এক সময় যখন সময়ের সাথে আবুল যৌবনের দরজায় পৌঁছে তখন অনেকদিন, অনেক বছর পরে ওমর বখত ফয়সালাবাদে ফিরে এসে দেখে তার এই এলাকার নাম আর লায়ালপুর নেই এটা এখন ফয়সালাবাদ হয়ে গেছে। খোদ বিলাতের বাসিন্দা নিজের ছেলের জন্য কনে খুঁজতে এসেছে, কম কথা নয়। তাদের পাশের এক গ্রামের মেয়ে রুখসানার সাথে ছেলের বিয়ে পড়িয়ে আবার পাকিস্তানে পাড়ি দেয়। ছেলেকে রেখে যায় বৌকে সাথে নিয়ে যাবার আয়োজনের জন্য এবং নিজের পিতৃভূমিতে কিছুদিন থেকে সবকিছু দেখেশুনে চিনে নেয়ার জন্য।
মাস ছয়েক থেকে বৌ এর কাগজপত্র ঠিকঠাক হলে একদিন তাকে নিয়ে আবার বিলাতে চলে আসে পূর্ব লন্ডনে বাবার ইস্ট হেমের বাড়িতে। রুখসানা বেগমের বাবা মায়ের সাথে দেখা করার জন্য হলেও অন্তত দুই বছরে একবার পাকিস্তানে যাতায়াত করতে হয়, সাথে আবুল বখতকেও যেতে হয়। রুখসানা বেগম একে একে ওমর বখতকে দুই নাতনি আর এক নাতি উপহার দেয় বলে তার মান এবং মর্যাদা শ্বশুরের কাছে অত্যন্ত বেড়ে যায়।
ফাতেমা সবার ছোট। বড় বোন কুলসুমের বিয়ে হয়েছে ওয়েস্ট হেমের আলী আসগরের সাথে আর মাঝে এক ছেলে হামিদ বখত। ওমর বখতের আপটন পার্কের এশিয়ান মুদি দোকানের ব্যবসা বেশ জমজমাট। ছেলে বড় হবার পর থেকে সে আর দোকানে বসে না। এর মধ্যে দিন বদলে গেছে অনেক। দোকান বড় হয়েছে, ব্যবসা বড় হয়েছে আবুল বখত এখন আর খুচরা দোকানদারি করে না। বাবার কেনা দোকান ভাড়া দিয়ে আপটন পার্কের দক্ষিণ মাথায় এক বিশাল পাইকারি দোকান বা ক্যাশ এন্ড ক্যারি দিয়ে ছেলে আর জামাইকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী কুলসুম আর হামিদ বখতের পড়ালেখা স্কুলের গণ্ডি পর্যন্তই শেষ কিন্তু ফাতেমা আবার এর বিপরীত। সে স্কুল ডিঙ্গিয়ে কিং’স কলেজে একাউন্টিং পড়ছে আর নিজের হাত খরচের জন্য টেসকোতে পার্ট টাইম মানে দিনে চার ঘণ্টা করে সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা কাজ করছে।
৪।
ফাতেমার নির্দেশ অনুযায়ী মেইন এক্সিটের বাইরে দাঁড়িয়ে সোলায়মান শুধু ঘড়ি দেখছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল এখনও ফাতেমা আসছে না! তাহলে কি ও আমাকে ফাকি দিল? না, ওর চেহারা মুখ বলে না যে এই মেয়ে কেউকে ফাঁকি দিতে জানে। গোলাপের মত নিষ্পাপ যার মুখ সে কি করে একজনকে ফাঁকি দিবে? নানা কিছু ভাবছে সোলায়মান। এমন সময় হটাত দেখল মেইন এন্ট্রান্সের পাশে ফুলের ব্লকের পাশ দিয়ে ফাতেমা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। টেসকোর পোষাক চেঞ্জ করেছে বলে ও চিনতে ভুল করেছে।
আসতে বললাম আর ও ঠিক আসছে এখন কি বলব, কোথা থেকে কি ভাবে শুরু করব এই সব ভেবে কিছুক্ষণের জন্য একটু হতবিহবল হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হাতের ফুলটার অস্তিত্ব দেখে যাচাই করে নিলো, ফুলটা ঠিক আছে। ফাতেমা বেড় হয়ে এদিক ওদিক দেখেই সোলায়মানকে দেখতে পেল। চার চোখের মিলনের সাথে আবার এক টুকরো মিষ্টি হাসি বিনিময়।
কি ব্যাপার, কি বলবে বল
একটু ইতস্তত করে পিছনে লুকিয়ে রাখা ডান হাতে ধরা লাল গোলাপটা সামনে এনে ফাতেমার দিকে বাড়িয়ে বলল
I love you Fatema! তুমি কি কোথাও এনগেজড?
ফাতেমা একটু থতমত খেয়ে আস্তে করে গোলাপটা হাতে নিয়ে হাতের গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট গুলি থির থির করে কাঁপা কণ্ঠে বলল-
সম্ভবত আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম!
এইতো শুরু হল সোলায়মান আর ফাতেমার এক নতুন অধ্যায়। দেখতে দেখতে প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেল কিন্তু কাদের কিছুই জানতে পারল না।
ওরা ভাবে আর কতদিন? লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, সারাটা দিন ছটফট করা, যতক্ষণ কথা হয় দেখা হয় ততক্ষণ একটা অজানা আতংকের মধ্যে থাকতে হয়। ফাতেমার রক্ষণশীল পরিবারের কারো চোখে পরে গেলে সর্বনাশের চূড়ান্ত কিছু ঘটে যেতে বিন্দুমাত্র দেরি হবে না। কতদিন এ ভাবে চলে? অবুঝ দুটি মনে কেউ কোন কিনারা পাচ্ছে না, কোন উপায় দেখতে পাচ্ছে না। ফাতেমা একবার না, দুইবার না অনেকবার বলেছে আমাদের যে পরিবার তাতে তাদের কেউ এই সম্পর্ক মেনে নিবে না! ফাতেমা সোলায়মনকে তার বাবা মা এবং দাদার বংশের কৌলিণ্য সম্পর্কে ভাল করে জানিয়ে বলেছে এরা নিজ বংশের কৌলিণ্য সম্পর্কে অতিরিক্ত খেয়ালী। কি জানি কি হয় আমার কিন্তু ভীষন ভয় করছে।
ওদের লুকিয়ে চুরিয়ে কথা হয়। ফাতেমার ডিউটি শেষ হলে পোষাক বদলে টেসকোর কাস্টমারের বসার জন্য যে বেঞ্চ আছে ওখানে বসে বা আড়ালে কোথাও দাঁড়িয়ে। তাতেও ভয়, যদি কেউ দেখে ফেলে! প্রেম! প্রেম কি আর ভূগোল মানে? সে কি আর অর্থ সম্পদ চায়? মান মর্যাদা বুঝে? সে তো হৃদয়ের ভিখারি!
ফাতেমা
শুনছি বল
চল আমরা লন্ডন ছেড়ে কোথাও চলে যাই!
কোথায় যাব? এটা ব্রিটেন, আমার নিখোঁজ সংবাদ যখন আমার পরিবার থেকে পুলিশকে জানান হবে তার দুই ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ আমাদের খুঁজে বের করে ফেলবে। জান এরা কি ভয়ংকর পুলিশ? তার চেয়ে তোমার বন্ধু কাদেরকে বলে দেখ সে যদি আমাদের কোন সাহায্যের পথ বের করে দিতে পারে!
তুমি এদেশের মেয়ে, তুমিই কোন পথ খুঁজে পাচ্ছ না, সে কি করবে? শুধু শুধু জানাজানি হবে! আচ্ছা বলত তোমাদের পরিবারে কে তোমাকে সবচেয়ে বেশে স্নেহ করে?
কেন?
না তাকে যদি বলে দেখতে পার এবং সে যদি কিছু করতে পারে!
না না সোলায়মান তা হবার নয়!
তাহলে?
তাহলে দেখি আরও কিছুদিন যাক, ভেবে দেখি।
ঠিক আছে তাই দেখ।
৫।
ফাতেমা অনেক ভেবে চিন্তে একদিন রাতে তার দুলাভাই দোকান থেকে ফিরে এলে তাদের এই কথা জানিয়ে একটা উপায় বের করে দেয়ার জন্য অনেক অনুনয় বিনয় জানাল। সব কিছু খুব মনোযোগের সাথে শুনে দুলাভাই তাকে উপায় বের করে দেয়ার জন্য আশ্বস্ত করে বলল তুমি কোন চিন্তা করনা আমি এর একটা ব্যবস্থা করব। শুনে আনন্দের আতিশয্যে সাথে সাথে সোলায়মানকে মোবাইলে সুসংবাদটা জানাল। ফাতেমা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে দুলাভাই এত সহজে তাকে সাহায্য করতে রাজী হবে। সে আজ একটা অসাধ্য সাধন করেছে মনে করে মনে মনে খুশীর জোয়ারে মুক্ত পায়রার মত নীল আকাশে উড়ছিল। সারা রাতে তার চোখে ঘুম নেই। শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি সে যেন এলো মোর দারে।
বেথনেল গ্রিন, গ্লোব রোড এবং ইস্ট হেমে দুটি নবীন এবং অবুঝ মন সময়ের অপেক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত গুনছে কখন সোনা ঝরা শুভ লগ্ন তাদের দুয়ারে উকি দিবে।
ব্রিটেনের অধিকাংশ সাধারণ বাড়ির মত ডুপ্লেক্স টাইপের এই বাড়ির এক তলার ফাতেমার রুমে সারা রাত জাগার ক্লান্তি নিয়ে ভোরের একটু আগে যখন দুটি চোখ ক্ষণিকের জন্য একটু এক হয়েছে ঠিক তেমনি সময় তার ঘরের দরজা খোলা এবং মানুষের মনের ষষ্ট ইন্দ্রিয়ের বিপদের একটা ইঙ্গিত পেয়ে ফাতেমার তন্দ্রা ভেঙ্গে দেখে তার মা দুটি হাত ধরে রয়েছে, দুলাভাই ধরে রেখেছে দুই পা। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তার কথার শব্দ পাচ্ছে পিছনে। পাশে মাংস বানাবার চাপাটি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাই, এক মাত্র ভাই যার কাছে সেই ছোট বেলা থেকে ছিল কত আবদার কত স্মৃতি জড়ান এই ভাইয়ের সাথে, সেই ভাই আজ তার গলায় চাপাটি ধরে রয়েছে! কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না। মা কি করে তার হাত দুটি এমন চেপে ধরে রেখেছে যে এক চুল পর্যন্ত নারার উপায় নেই। যে মা তাকে দশটি মাস পেটে ধরেছে আবার কত কি করে এত বড় করে তুলেছে সেই মা কি করে এ ভাবে তার হাত দুটি ধরে রেখেছে! বাবা কোথায়? মাথা ধরে রেখেছে যে সেই কি তাহলে বাবা? সব সম্পর্ক কি তাহলে এই দুলাভাইকে কাল রাতে বলার পর থেকেই শেষ হয়ে গেল? এই বংশের আভিজাত্য কি রক্তের সম্পর্কের চেয়েও কঠিন? ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল, কত কথা বলছে, প্রাণের কত আকুতি, বেঁচে থাকার কত অনুনয় কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। পিছন থেকে বাবা ধমকে বলে উঠল কি দেখছ? ছুড়ি চালাও। সাথে সাথে দেখল ভাই নিচু হয়ে চাপাটিটা তার গলা বরাবর এনেছে আর অমনিই ফাতেমার গলা খুলে গেল “মা তুমিও আমাকে বাঁচতে দিলে না?” সাথে সাথেই একটা অস্পষ্ট গোঙ্গানির শব্দের সাথে সব শেষ।
৬।
গত রাতেই ফাতেমা এত আনন্দ নিয়ে কথা বলল আর আজ সারাটা দিনেও তার কোন একটা কল নেই কেন? কোন কল ধরছেও না, কি ব্যাপার? সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ১০০ বার কল করেও যখন কোন সারা পেল না। সারা রাত একটুও চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকালে আবার ফোন করে কোন সারা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে পুলিশে জানাল। আমার বন্ধুর কোন খোঁজ পাচ্ছি না তাকে কল করেও ফোন ধরছে না। তোমরা কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?
ঠিকানা নিয়ে সেই সকালেই পুলিশ আবুল বখতের ইস্ট হেমের বাড়িতে ডগ স্কোয়াড সহ হাজির। বারিতে কেবল হামিদ বখত ছাড়া আর কেউ নেই। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কুকুর তার বসের হাত থেকে ছুটে যেখানে ফাতেমার দেহ লুকিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছে সেই কার্পেটের কাছে শুঁকছে আর ঘেউ ঘেউ করছে।
কি ব্যাপার? রক্তের তাজা গন্ধ কেন এই ঘরে?
কার্পেট সরিয়ে দেখা গেল মেঝের আলগা কাঠ। কাঠ সরিয়ে মাটি একটু সরাতেই দেখা গেল কাল রক্তে মাখান ফাতেমার নিথর দেহ কুণ্ডলী করে কোন রকম চাপা দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
হামিদ বখত পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছিল কিন্তু এই ব্রিটেনের রয়াল পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাই কি সম্ভব?
তোমার মা বাবা কোথায়?
ওরা কাল রাতে পাকিস্তান চলে গেছে।
দুলাভাই?
সে লিভারপুলে গেছে আজ সকালে।
কিসে গেছে কার নিয়ে নাকি ট্রেনে?
ট্রেনে।
পুলিশ হাতের ঘড়ি দেখে বলল এখনও লন্ডন ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারেনি।
সঙ্গে সঙ্গে লন্ডন এবং লিভারপুলের মাঝের স্টেশন রেডিং এ ফোন করে জানিয়ে দিল লন্ডন থেকে যত ট্রেন রেডিং স্টেশনে থামবে তার সব চেক করে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আলি আসগর নামের যে লোক পাবে তাকে এরেস্ট করে লন্ডনে পাঠিয়ে দিন, সে একজন খুন করে পালিয়েছে।

*** বাস্তবতার ছায়া অবলম্বনে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Golpo

ডাক্তার

ডাক্তার সাব কনতো দেখি আমি এখন উপায় করি কি
খেতে মোটেই পারিনা যে মন্ডা মিঠাই, নিমাই বাবুর ঘি।
বয়স আমার বাইশ, চুলেতে পাক ধরেছে ঘুম হয় না গাড়
পেটে ক্ষুধা চোখে ঘুম মাথায় পাকা চু্‌ল, দাতে বেজায় ধার।

একটু হা করুণ, জিহ্বা দেখি হাতটা কোথায় দেখতে হবে নাড়ী
নিজেই সব দেখি আ্মি, নার্স আর কম্পাউন্ডেরা বড্ড আনারি।
ওরে হেকমত আলি, থাক কোথায় এস কাছে কর কিছু কাজ
রুগী এলো চেম্বারে তাই ইনকাম হবে মস্ত ভারী আজ।

ইলিশ কিনব এক জোড়া, ভাজি হবে আরো হবে দোপেয়াঁজি
গিন্নিকে বলব আরো করতে একটু সরষে ইলিশ পটল ভাজি।
ডাক্তার বাবু, এইতো আমি হেথায় আছি দরজা্রই পাশে
দরকার হলে ডাকবেন আমায় একটু জোরে কেশে।

আন দেখি থার্মোমিটার, টেথিস্কোপ আর একটা ছুরি
দেখব কেটে পেটের ভিতর হয়েছে কি বিশাল কোন ভুঁড়ি!
সারাশীটা দাওতো দেখি ফেলতে হবে দাঁত, দুই তিন চারি
হাতটা তুমি ধর কষে বাকী যা আছে সবই আমি পারি।

এই তল্লাটে সবাই বলে ডাক্তার আমি অতি সরস জুরি মেলা ভার
এসেছেন আপনি সঠিক জাগায় চিকিৎসা পাবেন অতি চমত্কার।
ওহে বাবু অসুখ আমার পেটে, চোখে, মাথার চুলে লাগবে কেন ছুরি
আমায় বুঝি কেটে কুটে মেরে ফে্লার ছলা করছেন, এটা কোন চাতুরি?

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Fun

ঈদ মোবারক

Eid Mubarak

ছবিঃ তাসমিনা খালিদ

পৃথিবীর যে প্রান্তে যে যেখানে আছেন সবার জন্য আমি নীল নক্ষত্র এবং ইজি রেসিপির পক্ষ থেকে ঈদ মোবারক। সবাই আনন্দের সাথে ঈদ উদযাপন করুণ এই প্রত্যাশা।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Greeting

হল না মোর পটল তোলা এবার এই ঈদে

এইতো কয়েক দিন আগের কথা। তা গত ১০ই আগস্ট হবে মনে হয়, মানে ওই যেদিন ব্লগার্স ফোরামের ইফতার বিতরণের দিন ছিল। ব্লগে এই ইফতার বিতরণ এবং ইফতার পার্টির ঘোষণা দেখেই কোন ভাবে নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। ভীষণ লোভ হচ্ছিল কবে যাব, কবে সবার সাথে দেখা হবে এবং সবার উপরে কবে এই সব দুস্থ পথ

কলিদের সাথে নিয়ে এক সাথে ইফতার করব। গিন্নীর সাথে আলাপ পরামর্শ করতে করতে এক সময় সে একটু বিরক্ত হল। কোন পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে যাব পাঞ্জাবীর সাথে কোন টুপি মানাবে। টুপি মাথায় দিয়েই যাব নাকি পকেটে করে নিয়ে যাব! মাথায় দিয়ে গেলে সবাই কি কাঠ মোল্লা ভাববে? বাড়ি থেকে কখন বের হব, ইনসুলিন বাড়ি থেকে নিয়ে যাব না কি সাথে করে নিয়ে গিয়ে ওখানেই সময় মত নিয়ে নিব, একটু আগে যেতে পারলে সবার সাথেকটু বেশী সময় দিতে পারব কিছু আলাপ বেশী করা যাবে, আড্ডা হবে ষোল কলায় পরিপূর্ণ। ইত্যাদি নানান ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। সামাজিক ও পারিবারিক ভাবে ওই দিনে যারা নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছে সবাইকে বলে দিয়েছি সেদিন আমার নিজের অনুষ্ঠান আছেকারো নিমন্ত্রণ রাখিনি।

আস্তে আস্তে কেলেন্ডারে ২০১২ সালের আগস্ট মাসের পাতায় যেদিন ১০ তারিখ এলো সেদিনের জন্য কোন কাজের বরাদ্দ রাখিনি শুধু বাড়ির দুই একটা ছোট খাট কাজ করে জুম্মা পরব তার একটু পরেই বের হয়ে যাব। বিজয় সরণীর মোড়ের এন্ট্রান্স রেস্টুরেন্ট আমার বাড়ি থেকে আর কতটুকই বা পথ। কাজের মধ্যে যেমন মেঝ মেয়েটার আলমারির তালা নষ্ট হয়ে গেছে বলে আলমারির পাল্লা বন্ধ করতে পারছে না আর ছুঁচো ইঁদুর ইচ্ছে মত আলমারিতে ঢুকে কয়েকটা কাপর কেটে ফেলেছে বলে ওর আলমারির তালাটা বদলে দেব, আর নিজের ঘরে দেয়ালের ঘড়িটা ঝুলানোর জায়গা বদলে দেব যাতে সকালে ঘুম ভাঙলে শুয়ে শুয়ে সময় দেখা যায়।
সকালে ঘুম থেকে একটু দেরিতে উঠে পাড়ার হার্ডওয়ারের দোকান থেকে একটা তালা কিনে আনলাম। হটাত কি মনে হল, না আগে ঘড়ির জায়গাটা ঠিক করে নিই পরে আলমারি ঠিক করব। রমজানের ছুটির দিন বলে বাড়িতে মেয়েরা সবাই ঘুমে, আমার বাবা ছাদে আর বেগম সাহেবা খাটে বসে জানালার দিকে ঘুরে কোরান পড়ছে। সে জানে যে আমি মেয়ের আলমারি ঠিক করব। ঘড়ির জায়গা বদলাব এ কথা তাকে বলিনি বলে সে জানে না।
গ্যারেজে  রাখা টুল বক্স থেকে ড্রিল মেশিন, হাতুড়ি, প্লায়ার, রল প্লাগ, স্ক্রু এসব এনে ড্রেসিং টেবিলে নামিয়ে খালি পায়ে খালি গায়ে গিন্নীর পিছনে খাটের এ পাশে সুইচ বোর্ডের সাথে যেই ড্রিল মেশিনের প্লাগ ঢুকিয়ে সুইচ অন করেছি অমনি কেমন যেন একটা ভয়ংকর অচেনা অনুভূতি উপলব্ধি করলাম।
বাড়ির এই সব টুকি টাকি কাজ সেই ছোট বেলা থেকে নিজেই করি, যতটা প্রয়োজন ততটা সাবধানেই করি। তাছাড়া সেফটির বিষয়ে আমাদের নেভিগেশন স্কুলে একটা সাবজেক্ট ছিল। সেটা পড়েছি, অনেক প্রবন্ধ লিখেছি, অধস্তন কর্মচারীদের ট্রেনিং দিয়েছি এবং নিজেও যখন যেখানে যেমন সাবধানতা মেনে কাজ করতে হয় তার সব করি কিন্তু আজ কি করে যে এই ভাবে খালি পায়ে খালি গায়ে এমনকি ইলেকট্রিকের কাজের জন্য সেফটি গ্লোভসটাও হাতে না পরে এবং সাথে টেঁসটার না নিয়ে এই কাজ শুরু করলাম তা আমি কোন ভাবেই মেলাতে পারছি না। এই ভুল আমি কি ভাবে করলাম?
সে যাই হোক, একটু পরেই সামান্য চেতনা ফিরে এলো। দেখি আমি ফ্লোরে চিত হয়ে পরে রয়েছি আমার স্ত্রী আমাকে ধরে উঠাতে এসে যেই ধরেছে অমনি সেও এক শক খেয়ে আমার হাতে ঝুলন্ত ড্রিল মেশিন দেখে সাথে সাথে বুঝতে পারল এতো চেয়ার থেকে পরে যায়নি, এটা বৈদ্যুতিক শক। এদিকে আমিও দরজা আর ড্রেসিং টেবিলের মাঝে এমন ভাবে পরে রয়েছি যে আমাকে ডিঙ্গিয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছে না। অমনি সে চিৎকার করে তার সহকারিণী রেশমাকে ডাকতে শুরু করল আর ঘর থেকে বেড় হবার পথ খুঁজতে লাগল। রেশমা গ্যারেজ থেকে ওই সব টুলস বের করা পর্যন্ত আমার সাথেই ছিল, আমাকে এই ঘরে ঢুকতে দেখে রান্না ঘরে গিয়েছিল। ভেবেছিল ভাইয়া এখন আর মেঝ আন্টির আলমারি ঠিক করবে না, এ ঘর থেকে বের হলে তখন সাথে যাব।
আমার কিছু চেতনা ফিরে এসেছে। আমি বলছি ডাইনিং রুমে যে সাব ডিস্ট্রিবিউশন বোর্ড আছে ওটার সব সুইচ অফ কর আর সিঁড়ি ঘরের মেইন সুইচ অফ কর। রেশমা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ওই ভাবে পরে থাকতে দেখে আমার স্ত্রীর মত আমাকে ধরে উঠাতে চেয়ে সেও এক শক খেয়ে ঘাবড়ে গেল। কি হয়েছে? ও ভাবি কি হয়েছে, ভাইয়া এখানে কেন? ওর ভাবি চিৎকার করতে করতে কি করে যেন ঘর থেকে বের হতে পারল।
এর মধ্যে আমি ভাবতে পারছি। নানা কিছু ভাবছি। মনে হচ্ছিল আমার চিন্তা প্রবাহ ঘণ্টায় লক্ষ মাইল বেগে চলছে। আমি ২২ বছরের ডায়াবেটিসের রুগী এবং এখন রোজা করছি স্বাভাবিক ভাবেই দুর্বল শরীর, এভাবে আমি কতক্ষণ থাকতে পারব? আমাকে শক্ত হতে হবে, দেখি আমার শ্বাস বইছে কি না, নাকে হাত দিয়ে দেখলাম স্বাভাবিক, বুকে হাত দিয়ে দেখলাম স্বাভাবিক আছে। ড্রিল মেশিনটা আমার ডান হাতে ঝুলছে এবং হাতটা স্টিল ফ্রেমের চেয়ারের পিছনে কেমনে যেন আটকে আছে। চেয়ারের একটা পা আমার বা পায়ে ছুঁয়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে আছে বলে পাটা নারাতে পারছি না। ডান হাত মোটেই নারতে পারছি না। বা হাত দিয়ে ড্রিল মেশিনটা ছাড়াতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। বা হাতে বিদ্যুৎ চলে আসছে। ভাবতে পারছি যে একটা মোটা কাপড় পেলে মেশিনটা ছাড়াতে পারলে হয়ে যেত। ওদের চিৎকারে মেয়েরা জেগে উঠে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখে হতবিহবল হয়ে কিংকর্তব্যবিমুর হয়ে গেল। বড় মেয়েটা আমাকে ধরে উঠাতে গিয়ে সেও এক শক খেল। আমি ওকে বলছি আমাকে ধরবে না কিন্তু বাবাকে এই ভাবে পরে থাকতে দেখে কেইবা মেনে নিতে পারে? ছোট মেয়ে এসেও তার একই অবস্থা। আমি বললাম আমাকে একটা মোটা কাপর দাও আমার ডান পাশেই একটা পাপোষ, খাটের পাশে পাপোষ, বিছানায় জায়নামাজ বিছানো যাতে বসে আমার স্ত্রী তেলাওয়াত করছিল আর ওই পাশেই একটা গায়ে দেয়ার কাঁথা। ও  দিকে কারো দৃষ্টি যাচ্ছে না, ছোট মেয়েটা গলা থেকে ওড়না খুলে দিল। বাম হাতে ওড়না নিয়ে মেশিনটা ছাড়াবার চেষ্টা করলাম কিন্তু পাতলা ওড়না ২২০ ভোল্টের প্রবাহ ঠেকাতে পারল না।
আমি ভাবছি:
মনে হচ্ছে ওরা আমাকে বাচাতে পারছে না, আজ রোজা থেকে জুম্মার দিনে নামাজ না পরেই আমাকে নিয়ে যাবে আল্লাহ! একটু পরেই জুম্মার আজান দিবে, এতো সুখের মৃত্যু কিন্তু আমার স্ত্রীকে যেভাবে চিৎকার আর কান্না কাটি করতে দেখছি, আমার মেয়েরা যে ভাবে কাঁদছে আর ছোটা ছুটি করছে তাতে ওদের কি হবে? মেঝ আর ছোট মেয়ের এখনও যে পড়া লেখা শেষ হয়নি বিয়ে দিতে পারিনি ওদের কি হবে? বিদ্যুতায়িত মানুষ কি এতক্ষণ বেচে থাকতে পারে? যে রক্ত মাংসের দেহে ২২০ ভোল্টএর বিদ্যুৎ ৪/৫ মিনিট ধরে অনবরত প্রবাহিত হচ্ছে সে কি বেচে থাকে? তাহলে কি আমি মরে গেলাম? না! আমি কি তাহলে এখনও মরিনি? তাহলে আমার স্ত্রী সন্তানেরা এমন কাঁদছে কেন? খুকুর মা, তুমি কি এখনও মেইন সুইচটা অফ করে আমাকে বাচাতে পারলে না? মনে হচ্ছে আমি সব কিছুই ঠিকঠাক ভাবতে পারছি তাহলে আমি উঠতে পারছি না কেন? কি হল?
ওদিকে আমার স্ত্রী, রেশমা এবং আমার মেঝ মেয়ে ডাইনিং রুমের সেই সাব ডিস্ট্রিবিউটারের সব সুইচ অফ করেছে সাথে আবার কাট আউট গুলিও খুলে নিয়েছে (আমিই শিখিয়েছিলাম যখন ইলেকট্রিক লাইনে কাজ করবে তখন মেইন কাট আউট খুলে পকেটে নিয়ে বা ভিন্ন কোথাও লুকিয়ে রেখে কাজ করবে যাতে অন্য কেউ না জেনে হটাত করে কাট আউট লাগিয়ে দিতে না পারে)।
এর মধ্যে আব্বা নিচের এই চ্যাঁচামেচি শুনে নিচে এসে সিঁড়ি ঘরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে? আমার স্ত্রী বলছে মেইন সুইচ অফ করুন তাড়াতাড়ি।
কেন কি হয়েছে?
রেশমা মেইন সুইচ বোর্ডের ঢাকনা খুলে সুইচ অফ করে দিয়েছে কিন্তু আমার স্ত্রী ভিতরে ঢুকে দেখে তবুও ডাইনিং স্পেসের পাখা চলছে!!! একি! তাহলে এখন কি করব? হটাত করেই তার মনে হল আরে, সব কিছু অফ করলে কি হবে, সারা বাড়িতে যে IPS এর লাইন দেয়া রয়েছে। তাহলে ওটা থেকেই বিদ্যুৎ নিয়ে সব কিছু যেমন ছিল তেমনই চলছে। দৌড়ে পাশের স্টাডিতে রাখা IPS এর সুইচ অফ করার সাথে সাথে সম্পূর্ণ বাড়ির বিদ্যুৎ অফ হল এবং আমি দেখলাম আমার হাতে লেগে থাকা ড্রিল মেশিনটা ছুটে পরে গেল।
এবার আমি উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েরা সবাই এক সাথে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! এই এতক্ষণ ধরে যার ভিতর দিয়ে চলছিল ২২০ ভোল্টের বিদ্যুৎপ্রবাহ সেই আমি যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে বললাম কি ব্যাপার তোমরা এমন করছ কেন? আজান দিয়েছে? গোসল করতে হবে নামাজে যাব। মেয়েদের পিছনে ওদের মা, রেশমা আর আব্বা দাঁড়িয়ে। শুনে মেয়েরা বলল
আব্বু কি বলছ তুমি? তোমার কি হয়েছিল জান?
কেন, কি হয়েছিল? হ্যাঁ এইতো ড্রিল মেশিনটা লিক ছিল বলে একটু শক লেগেছিল, এইতো আর কি?
আব্বু শোন।
বলেই ওদের মায়ের দিকে ঘুরে বলল আম্মু বল-
ওদের মায়ের বক্তব্য;
আমি জানি তুমি মাঝুর আলমারির তালা বদলাবে তাই তোমাকে বললাম রেশমাকে সাথে নিও আমি আর কয়েক রুকু পড়ে আসছি। হটাত তোমার কণ্ঠের বাবাগো চিৎকার আর তার সাথে ধপাস করে ভারী কিছু পরে যাবার শব্দ শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখি তুমি দরজা আর ড্রেসিং টেবিলের পাশে চিত হয়ে কুকরিয়ে পরে রয়েছ পাশে চেয়ারটা পরে আছে। আমি কোরান শরিফ রেখে তোমাকে তোলার জন্য খাট থেকে নেমে যেই ধরেছি আর অমনি মনে হল কেউ যেন আমাকে টেনে ধরছে। তুমি বলছ মেইন সুইচ অফ কর, তোমার এই কথা আর টেনে ধরা বুঝে অনুমান করলাম এটা ইলেকট্রিকের ব্যাপার, তখন পাশে দেখি তোমার হাতে ড্রিল মেশিনটা ঝুলছে। এদিকে আমি যে রুম থেকে বের হব সে উপায় নেই, তুমি সম্পূর্ণ পথ জুরে রয়েছ। তখন রেশমাকে ডাকলাম ও এসে তোমাকে এই অবস্থায় দেখে আমার মত তোমাকে তুলতে গিয়ে আমার মত একই অবস্থা। এর মধ্যেই আমি কি করে যেন ফাঁক খুঁজে রুম থেকে বের হয়ে প্রথমে ডাইনিং রুমের বোর্ডের সব সুইচ অফ করে কাট আউট খুলে ফেলার পরেও দেখি ফ্যান চলছে তখন সিঁড়ির মেইন বোর্ডের সুইচ অফ আর কাট আউট খুলেও যখন দেখলাম ফ্যান চলছে তখন ভাবলাম আর বুঝি আমি তোমাকে বাচাতে পারলাম না।  হটাত করেই মনে হল কে যেন কানে কানে বলল বোকা IPS অফ করও হ্যাঁ তাইতো, ওটা দিয়ে যে পাওয়ার আসছে তা বন্ধ না হলে হবে না। দৌড়ে তাড়াতাড়ি ওটা অফ করতেই সব ডিসকানেক্ট হবার পর আল্লাহর রহমতে তুমি ছাড়া পেলে। মনে হল আল্লাহ তায়ালা নিজে কোন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে আমার কানে ওই কথা বলিয়ে দিয়েছে।
ওদের মায়ের এই কথা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্তি বোধ করছিলাম বলেবিছানার পাশে বসেছি কিন্তু কখন যে শুয়ে পরেছি জানি না। মেয়েরা আমার সমস্ত শরীর মেসেজ করে দিচ্ছে। মাঝু আবার নিউট্রিসনিস্ট, ও সমস্ত শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল কোথাও কোন মাংসপেশি শক্ত হয়ে আছে কি না। বড় মেয়ে ব্লাড প্রেশার, পালস রেট, ব্লাড ফ্লো আর সুগার দেখে নিয়ে আমার ফিজিশিয়ানকে ফোন করে জেনে নিল কি করতে হবে। জামাইকে সাথে সাথে দোকানে পাঠিয়ে ওষুধ আনিয়ে নিল। আমি এই কয়েক দিনে ডাক্তার দাউদের সাথে যে হৃদ্যতা হয়েছে সেই সুত্র ধরে তাকে জানাবার জন্য মেয়েদের বললাম আমার ফোনটা এনে দাও। ফোন করলাম কিন্তু কি বললাম না বললাম কিছু না বুঝে ফোনটা আমার গিন্নীর কাছে দিয়ে জড়ান কণ্ঠে বললাম কথা বল তোমার নাতির সাথে।
মেঝ মেয়ে এক গ্লাস গরম দুধ এনে বলল খেয়ে নাও সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে
আমি রোজা না?
হ্যাঁ রোজা আছ ঠিক আছে কিন্তু এখন এই দুধ খেলে রোজা ভাঙবে না, নাও খাও
বলে আমার মাথাটা দুই বোনে মিলে বালিশ থেকে উঠিয়ে ঠোটের কাছেগ্লাসটা ধরল আর আমিও কেমন যেন সম্মোহনের ঘোরে খেয়ে ফেললাম, এমনিতেও ভীষণ পিপাসা পাচ্ছিল কিন্তু রোজা আছি আবার ইফতারির অনুষ্ঠানে যাব বলে কিছু বলছিলাম না।
আব্বু তোমাকে আবার নতুন করে পেলাম আমরা!
হেয়ার ড্রাইয়ার আর এস্ত্রি এনে তোয়ালে গরম করে আমাকে গরম রাখার চেষ্টা করছিল
ডাক্তার দাউদের সাথে কথা বলে আরও কার কার সাথে যেন কথা বলল, সবাইকে বলল দোয়া করতে বলবেন। পরে সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পাবার পর জানলাম শিবলি ভাই আর লুবনা আপাকে ফোন করে আমাদের ইফতারে যাওয়া হচ্ছে না এই কথা জানিয়ে দিলাম আর দোয়া করতে বললাম। এদিকে বড় মেয়েটাও দেশে বিদেশে সব আত্মীয় স্বজনদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছাবার চেষ্টা করছে। এক ফাকে বলল আমি গত কয়েক দিন ধরে আব্বুকে নিয়ে নানান হাবিজাবি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম, মাঝুও তাই বলল এ কথা শুনে ওদের মাও একই কথা বলল। আমার বোন বলল আজ কেন যেন হটাত করে আমার হাত থেকে বালতি পরে ভেঙ্গে গেল। সময় হিসেব করে ও বলল হ্যাঁ ফুপি ঠিক একই সময়ে ঘটেছে এই ঘটনা। ইংল্যান্ডে ওদের সেঝ চাচী বলল তোমার চাচা আজ সেহেরী খেয়ে বলছিল আমার এমন অস্থির লাগছে কেন? ওদের এই সব কথা ঘোরের মধ্যে থেকে কিছু কিছু শুনছিলাম।
যে মানুষটাকে নিয়ে জীবনের সুদীর্ঘ ৩৬ টি বছর পার করে দিলাম এর মধ্যে কত ঈদ আনন্দ দুঃখ কেটেছে কিন্তু কোন দিন যার মুখ থেকে এ কথা শুনিনি যে এবার ঈদে বা এই অনুষ্ঠানে আমাকে এটা ওটা কিনে দিবেসেই মানুষ এবার রমজানের শুরু থেকেই বলছিল এবার আমাকে খুব দামী একটা শাড়ি দিবে আর শাড়ির সাথে ম্যাচ করে সব কিছু কিনে দিবে। আমি শুনে ভাবছিলাম এ কি শুনছি? জীবনে কোন যা শুনিনি! এত কাল প্রতিবার জিজ্ঞেস করে বরাবরের মত এক উত্তর (যা আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল) পেয়ে আমার পছন্দ ও সাধ্য মত যা কিনেছি তাতেই খুশী দেখে অভ্যাস হয়ে গেছে কিন্তু সেই খুকুর মা এবার এমন করে কেন বলছে??? খুকুর মা কি আমার সাথে রসিকতা করছে! মনে কেমন যেন একটা খটকা লাগল। কেন এমন করে বলছে? এই কি তাহলে আমার শেষ দেয়া??? অবাক হয়ে শুনেছি। এইতো কয়েক দিন আগে বাজারে গিয়ে একটা VISA কার্ড হাতে দিয়ে বললাম তোমার যা ইচ্ছা দেখে পছন্দ করে নিয়ে চল, আনলিমিটেড। কিচ্ছু ভাববে না শুধু দেখবে পছন্দ করবে আর ট্রলিতে ভরবে। বড় জামাই শাড়ি দিয়েছে বলে শাড়ি কিনেনি। শুধু এক জোড়া স্যান্ডেল আর একটা পাথরের কানের ফুল ব্যাস এই! আমি দেখে অবাক! কি ব্যাপার, শাড়ি??
শাড়ি দিয়ে কি করব?
অন্য কিছু?
অন্য আবার কি?
এ কয়দিন ধরে যে বললে!
যখন বলেছি তখন বলেছি, তাই বলে কি সত্যিই কিনতে হবে?
বাহ! নিজেই বললে আবার কি হল?
আরে না আমি এমনিই বলেছি চল, এই নাও কার্ড।
পকেট থেকে পেমেন্ট দিয়ে চলে এসেছি।
সে রাত কোন ভাবে কেটে গেল। সেহেরীতে ডাকেনি। সব টের পেলাম পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর। সমস্ত শরীরে ব্যথা আর যেখানে যেখানে আঘাত লেগেছে সে সব জায়গা নীল হয়ে গেছে। যে হাতে মেশিনটা ধরা ছিল ওই হাতে কেমন যেন আগুনে স্যাকা লাগা ভাব, পরে যাবার সময় ড্রেসিং টেবিলের কোনায় লেগে ডান হাতের বাহুতে, ডান হিপ জয়েন্টের নিচে যেখানে ফ্লোরে পরেছিলাম সেখানে আর বা পায়ের হাঁটুতে কি করে যেন আঘাত লেগে নীল হয়ে আছে আর পরার ঝাঁকুনিতে কোমরে যে আঘাত লেগেছে তার ব্যথায় দাড়াতে পারছি না।
যখন সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পেলাম তখন ভাবলাম, ভেবে দেখলাম কেউ মানুক বা না মানুক এই পৃথিবীতে যত শক্তি আর ক্ষমতা আছে তার সব কিছুর একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং। তিনি যখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। এই আমারই কত কি হতে পারত! ফাইনাল স্টেজে পটল তুলতে পারতাম, যে হাতে মেশিনটা ধরে ছিলাম সেটা পুরে যেতে পারত কিংবা সারা জীবনের জন্য অবশ হয়ে যেতে পারত, শরীরের ভিন্ন কোন অঙ্গ প্যারালাইজড হতে পারত, স্মরণ শক্তি বিলুপ্ত হতে পারত। কিন্তু কিছুই হয়নি। অর্থাৎ তিনি চাননি কিছু হোক। আলহামদুলিল্লাহ। বাড়িতে এখনও একটা আতংকের ঝর বইছে। কি হয়ে গেল! আত্মিয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব আর পাড়া প্রতিবেশিরা এসে দেখে যাচ্ছে।
দেখে এলাম ওপাড়ে যাবার দরজা। সত্যিই নব জীবন।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Life

ঈদ শপিং

নিউ মার্কেট আর গাউসিয়াতে চলছে কেনা কাটা
দেশটি জুরে কোথাও আর নেই যে কোন ফাকা
এখান থেকে ওখানেতে চলছে ছোটাছুটি
কোন বাজারে পাবে পোশাক হবে মোটামুটি
দামে কম লাগবে ভাল দেখতে হবে খাসা

পড়শিরা সব বলবে ভাল এইতো এখন আশা
চমকে দেব নতুন কাপড় নতুন ডিজাইন
হাল ফ্যাশনের  ছড়াছড়ি কোনটা হবে ফাইন।
এখানে নয় ওখানে চল গিন্নী ধরে বায়না
হাটা হাটি ঘোরা ঘুরি আর যে দেহে সয় না।
ভিউ প্যালেসে এসে বধূ শাড়ি নিয়ে হাতে
দাম শুধাল দোকানীরে আমায় নিয়ে সাথে
ষাট হাজারে দিতে পারি, প্যাকেট করব নাকি
এটাই আসল বেনারসি আর যে সকল মেকি।
দামটি শুনে আঁতকে উঠি, একি হল হায়
পকেট কখন উবে গেছে প্রাণটা বুঝি যায়!
গিন্নী আমার অতি ভাল সাহস করে বলি তারে
চটপটি আর ফোস্কা খেয়ে এবার চল ঘরে।
কালকে তোমায় শাড়ি দেব, আর যা আছে কিছু
কেন তুমি মিছে আমায় মন ভুলিয়ে আনলে পিছু?
কেমন করে বলি তারে পকেট আমার ফাকা
কোথা থেকে পাব এখন এত গুলি টাকা?
চুপটি করে বসে আছি মাথায় দিয়ে হাত
বুঝতে তিনি চায়না মোটে কোন অজুহাত।
চারিদিকে লাল নীল জ্বলছে বাতির বাহার
এবার বুঝি ভাংবে আমার এত দিনের সংসার।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Festival

সুমধুর আজান

হারিয়েছি ফজর ঘুমের ঘোরে
যোহর গেল সেই কোন প্রহরে।
আসরে চেয়ে দেখি আর নাই বেলা
মাগরিব গেল যখন করি খেলা
এশা যে কখন এসেছিল বুঝি নাই অন্ধ মোহে।

আমার পাপের হিসাব জমেছে কত তোমার খাতায়
হে করুণাময় পরওয়ারদিগার ক্ষমা কর তুমি আমায়।
সকল কাজ ফেলে যেন যাই ছুটে তোমারই ঘরে
দু হাত তুলে মুনাজাত করি যেন ইবাদতের পরে।
পার কর হে রহমানুর রহিম, হৃদয়ে ভাসিয়ে দাও
তোমার নামের মহান মহিমা ভরা রহমতের নাও।
রুধির ধারা বহিয়ে দাও তোমার প্রেমের স্রোতে
মরমে বেধে সুর আজানের মাঝে সন্ধ্যা প্রভাতে।
যে সুর তুমি দিয়েছ আজানের মাঝে ধরণীর পরে
সেই সুর বাজুক দিনমান আমার প্রাণে আমার ঘরে।
তোমার আমি যেন পাই আমাকে খুঁজে তোমারই মাঝে
ইবাদত বন্দেগী করি যেন দিবা নিশি আর সকাল সাঁঝে।
শয়তানের ছলনা যত আছে সব যেন চলে যায় দূরে
আজানের ধ্বনি এসে বাজুক আমার বুকে সুমধুর সুরে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under poems

ঈদের বাজার

একটা মোটে গিন্নী আমার বড়ই হৃদয়বান
এবার ঈদে শাড়ি না পেলে করবে সে জান কোরবান।
ইফতারির পরে সেদিন এগিয়ে দিল এক লিস্টি
ভাবলাম বুঝি কিনতে আমায় বলবে কিছু মিষ্টি।

পড়ে দেখে প্রাণটা আমার চাইল, ছেড়ে যেতে খাঁচা
মনে বলে পরেছিস ফান্দে এবার, জানটা এখন বাঁচা।
ফর্দে লেখা চারটা শাড়ি তার দুইটা বেনারসি
একটা হল জামদানী আর একটা আনারসি।
জুতা স্যান্ডেল লাগবে কতেক মার্কা হবে বাটা
আরাম আয়েস সবই হবে থাকবে সুখে পা’টা।
তার সাথে থকবে সব ম্যাচিং করা হাতের চুরি
কানের দুল, গলার মালা মেলবে না তার জুরি।
নেইল পালিস, লিপস্টিক আর চোখের কাল কাজল
সাজব আমি থাকবে লোকে মেলে চোখটি সজল।
একটু পরে মেয়েরা সব দল বেধে এল বাবার কাছে
এসেই দেখে বাবার পাশে চুপটি করে মা বসে আছে।
মায়ের মত ভবটি ধরে বলল হেসে হেসে
কিচ্ছুটি আর যায়না পাওয়া এই পোরার দেশে।
ইদের পোষাক কিনতে আমরা যাব সিঙ্গাপুরে
ইচ্ছে যদি কর তুমি যেতে পার এক মজার টুরে।
বললাম আমি হতাশ হয়ে লাগবে কত টাকা
জীবন আমার নর বড়ে নেই যে চলার চাকা!
টাকা অতি তুচ্ছ ব্যাপার, লিখে দাও একটা চেক
দশ নয়ত বিশ লাখের মাঝেই সব, মানিয়ে নেব বেশ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under Festival

শ্রাবণ গগনে

<Digimax S1030 / Kenox S1030>
ছবিঃ তাসমিনা খালিদ

সঘন শ্রাবণে মেঘলা গগনে
এলো যে বরষা হায় এলো যে মনের বনে।


রিমঝিম কলতানে অবিরাম গাছের পাতায়
তোলে গুঞ্জণ। যুঁই চামেলির পাতায় পাতায়
লাগে শিহরণ,  কানে কানে কি গান গেয়ে
ঝিরি ঝিরি বাদল ফোটা মনে যায় দোলা দিয়ে?
জানালার ওপাশে পুকুরের বুকে টুপটুপ ঝরে বৃষ্টি
মনে হয় যেন আর কোন দিন ফেরাব না দৃষ্টি।
এ যেন আকাশের জলকেলি পুকুরের সাথে
নদী নালা সবকিছু একাকার মাঠে আর ঘাটে।

দোলনচাঁপার পাপড়ি গুলো নুয়ে বলে কাছে এস
শালুকের পাতা বলে থির থির কেঁপে, আমায় ভালবেসো!
কামিনী কাঞ্চন ফুটে আছে কত বাগানের ওই ধারে
সুর ভরা এই দিনে সবই আছে শুধু তুমি নেই পাশে!
খালে বিলে জল রাশি ঝুরঝুর ঝুরছে
বাগানে কত কুসুম কলি হেসে হেসে ফুটছে।
মন বলে শোন, এমন দিন যেন হয় না বৃথা
কাছে যদি আস তুমি কানে কানে কব কত কথা।
সবইতো রেখেছি সঞ্চীয়ে মনের গোপন কুঠিতে
যে কথা যায় না বলা সখী আভাসে আর চিঠিতে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান

Filed under poems